Saturday 7 July 2018

অতিক্রম 
#মৌসুমী রায় 
আজ বাড়িতে ষষ্ঠী পুজো। যমজ কন্যারা ছয়দিনে পা দিয়েছে।   বাড়ির বড় আদরের মুসু আর রূপু ।জন্মের পরপর দিম্মি  ও ঠাম্মির নামে ডাকা হতো ওঁদের। নামকরণ হয়নি। ডাক নাম ওই ই ওদের। আর বদল হয়নি।  ভালো নাম   মুস কান  সেন গুপ্ত আর রূপটান সেনগুপ্ত। 
গম রঙের সাথে পানপাতা মুখ ,পটলচেরা চোখ ,একমাথা ঘন কালো চুল পিঠের ওপর ছড়ান ,বেদানার  মত সাজানো দাঁতের হাসি ঝরে পড়ে মুসুর । আর গ্রীবাটিও রাজহংসীর মতো। নৃত্যে পটিয়সী হওয়ায় গ্রীবাটি যেন অতীব সুন্দর। 
রূপু গান জানে ,আবৃত্তিও জানে,সাথে  ওদের মা ও  । গানে রবিঠাকুর আর নৃত্যে কত্থক। দুটিতেই যখন তাল দেয়  রূপু আর মুসু ,সেটাও দেখার মতো। 
বিশ্বকর্মা যেন কতো সময় নিয়ে ওদের গড়েছে। 
আজকাল পথে ঘটে বড্ড নজরে রাখতে হয়। মেয়েদের  মা, এই দায়িত্বে। ঠাম্মি  আর দিম্মি সংসারের সমস্ত কিছুই সামলায়। বলেন আগে আমার নাতনিরা  পরে সব কিছু। বোধকরি বাড়িটি ও  সদস্যদের বিশ্বকর্মা দেহে মনে একই সুতোয় বেঁধেছে। তবে মুসু  আর রূপুদের  বুঝতে দেওয়া হয়না যে তোমরাই  সব। কারণ  শৈশব যাতে অহংবোধে হারিয়ে না যায়।  তোমরা আর পাঁচটা বাচ্চা দের মতো বড় হও। মুসু  রূপু এতো মিষ্টি যে বলার অপেক্ষা রাখেনা। পাড়ার দাদারাও মুসুদের  খুব স্নেহ করে।
--একবার  হল কী  ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "পথিক "কবিতা অবলম্বনে পাক্কা আধঘন্টার এক পলকহীন অনুষ্ঠানের আয়োজন। তাঁর মধ্যমণি কেও ছিলোনা ,কিন্তু অপূর্ব এক অভিনবত্ব এনেদিয়ে ছিলো। বলা বাহূল্য রবি ঠাকুর একাই সব। তবুও যথাযথ পরিবেশনের দায়িত্বও কম নয়।পাড়ার দাদাদের স্নেহের ও শাসনের সুবাদে।মুসকান ,ওর মা এবং মুসু আর রূপটান এর পরিবেশনা। রূপটান ও খুব মিষ্টি। শ্যামলা বরণে আরও মাধুরী।পঁচিশে বৈশাখ ,সকাল সকাল উঠে বেশ উৎসবের মেজাজে দুই বোন। অন্যদিন দেরীতে ওঠে ,তাও আবার ওঠরে ,ওঠরের ফল। ওদের কলেজ থাকে যখন তখন সেটা বলতে হয়না । দুইজনেই নৃত্য এবং সঙ্গীত নিয়ে পড়ছে।
 সকলেই বেশ আগ্রহী। মায়ের পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু অনুষ্ঠান। "পথিক ওগো পথিক ,যাবে তুমি এখন এ যে গভীর ঘোর নিশা ---বিদায়পথে দিয়েছি বটে বাধা "গলার ওঠানামার করুণ আবহে রূপটানের মিষ্টি গলায় "মোরে বারে বারে ফিরালে ,মোরে --"সুরের মূর্ছনায় দর্শক আপ্লুত। আবার শুরু "পথিক "কবিতার পাঠ। "পথিক ওগো মোদের নাহি বল ---রয়েছে শুধু আকুল আঁখিজল " কত্থকের শৈলীতে "কাঁদালে তুমি মোরে "গানের সাথে মুসকানের নৃত্য পরিবেশন এক অন্যমাত্রা এনেছিল। আবার শুরু "তিমির রাতি --হৃদয়ে তব আসিল অবতরি "রূপটানের গলায় "আজি এ নিরালা কুঞ্জে আমার অঙ্গ মাঝে "ঝোরে পরছে "লতায় লতায় "শব্দের অর্থে। পরিবেশ স্তব্ধ ,সেখানে একজনের অস্তিত্ব তিনি স্বয়ং রবি ঠাকুর।
আবার শুরু পথ চলা পথিকের। "পথ পাগোল পথিক ,রাখো কথা ,নিশীথে তব কেন এ অধীরতা।"রূপটানের গানে মুসকানের নৃত্য "হায় অতিথি ,এখনি কি হোল তোমার যাবার বেলা --
---আমোদ আহ্লাদ উছলে পড়ে বোধকরি পরিবারটি । আড়ালে মুসু আর রূপুর কথপোকথন শোনে ওদের মা। কত কথা তার শেষ নেই।আজ ওদের বিষয় পাহাড়। সান্দাকফু ভ্রমণ ওদের মনে আনন্দ দিয়েছিলো। মানেভঞ্জন থেকে হাঁটার কথা ছিল ,পরে গাড়িতেই যাওয়া হয়েছিল।পৌঁছনোর চার কিলোমিটার আগে গাড়ি বিকল। এবার হাঁটতে হবে। বেশ আনন্দ হচ্ছিলো প্রথমে। রাস্তা এতো খাড়া যে অংকের জ্যামিতির কথা মনে পড়ছিল। কখন পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ তো কখনো ষাট ডিগ্রি। বুকের ভিতর পাথরের বোঝা নিয়ে পাহাড়ে ওঠা। সে এক প্রাণবায়ূ বেরোনোর উপক্রম।  চলতে চলতে কাজু ,কিশমিশ দুচারটে মুখে চিবোতে চিবোতে একঢোক একঢোক জল পান। এই মুসু ,রূপুর ডাকে পাহাড়ের গায়ে লেগে প্রতিধ্বনি এক অনুরণন সৃষ্টির দুনিয়ায় পৌঁছে যাচ্ছিল। রুক্ষ পাহাড় এর  গায়ে গাছ গাছালির পোশাক পড়েছে। পাহাড়ী ফুলে ফুলে অলংকারের সম্ভার সাজিয়ে রেখেছে। রঙিন ফুল দুই বোন চুলে গুঁজে নিচ্ছে ,মায়ের খোঁপায় গুঁজে দিচ্ছে। দুই বোনে ভূপালী সুরে তান বাঁধছে। এই সব চলছে চলার পথে যখন একটু জিরিয়ে নিচ্ছে ওরা। মা ওঁদের গল্প শুনছে আর ঝালিয়ে নিচ্ছে নিজের আনন্দটাও।বাবা তো বোমভোলা। মেয়েরা প্রাণ ভোমড়া। ঠাম্মি , দিম্মী মানে ভঞ্জনে আছেন নেপালী মহিলা পরিচালিত হোটেল এ। নেপালী মেয়েদেরও ঠাম্মি ,দিম্মি।
---পাহাড়, পুরুষ এবং  মূর্তিমান হলে কি হবে তার স্নেহ ভালোবাসার সম্পূর্ণতা যেন বাবার মত। কোথাও প্রশ্রয় তো কোথাও নিষেধ। যেমন ধর পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ কর এটা প্রশ্রয় আর খাদের কিনারে যেতে বারণ এটা নিষেধ। পাহাড়ের অলিখিত নিয়ম। এক পুরুষের কত ভাগ ,যেমন কখনো সে সন্তান ,কখনো ভ্রাতা আবার কখন সাথী বা বন্ধু ,আবার জীবনে চলার পথের সঙ্গী এবং পিতা।
মুসু আর রূপুর উপলব্ধি একই। পথে চলতে চলতে পুরুষের বিশ্লেষণ ওদের মা কে জানান দিলো ওরা সাবালিকা। আর চিন্তা নেই ঠিক পথেই ওরা এগোচ্ছে। পৌঁছে যখন ওরা বিশ্রাম নিচ্ছে তখন সন্ধ্যে নেমেছে। আকাশ ভরে জ্যোৎস্না আর কিরণ লেগেছে পাহাড়ের কোণে কোণে। যেন লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ। গানে গানে ভোরে উঠল মোহময়ী রাত।
ফেরার পথে গাড়ি পাওয়া তে সবাই খুশী। রাস্তায় পাহাড়িমেয়ে ,বাচ্চাদের দল সে এক বসন্ত সমাগম। ওদের হাতে চকলেট ,কাজু ,কিশমিশ দিচ্ছে মুসু ,রূপু। চা খেতে নামার ফাঁকে একটু এদিক দেখা ,মানুষের সাথে কথাবলা। খুব মিষ্টি ওরা। সরলতায় স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে গোলাপী গালের চ্যাপ্টা নাক এর ঝলমলে চোখের মুখ গুলো। মেঘমা ,টুমলিং ,গৌরীবাস জায়গার নাম গুলো মানুষ গুলোর মত সুন্দর। পাহাড়ের একলা পথে যেতে যেতে পাহাড়ী ছেলেদের সহযোগিতা মুগ্ধকর। হাসি মুখের অধিকারী সম্প্রদায় পাহাড়ি মানুষরা।
রূপু ,মুসুদের পাহাড় কে পুরুষ কল্পনা করে নানান পর্যায় ভুক্ত করেছে। পুরুষ না থাকলে নারী র সৌন্দর্য অপূর্ণ।
----নদীর গতি ধারাকে নারীরূপে কল্পনা। একেকদিন ছুটি পেলেই দুই বোনের কল্পনা বন্যা বইয়ে দেয়। ওদের দুই পুরুষ বন্ধু আছে রুনু  আর ঝুনু । ওরাও ছুটির দিনে যোগদেয় আদর খায় ওরাও  আদর করে।মুসু আর  রূপু দের । জ্বর জ্বালা সবই যমজের যমজ। বোধকরি চিন্তা ধারাও একই। দুজনেই মেধাবী। একজন নাচে আর একজন গায়। এভাবেই ওদের আলাদা করা যায় নচেৎ নয়। ও হ্যাঁ আজকের ছুটির দিনে ওদের বিষয় নদী। ওঁরা যখন আলোচনা করে তখন নিশ্চুপ শ্রোতা রুনু আর ঝুনু । কোনো উৎপাত নেই ওদের। বরং আলোচনা র থেকে অন্য কিছু ঘটলে মারাত্বক। রুনু  আর ঝুনু তখন নিজেদের মতো কোরে কলহ জুড়ে দেয়। তখন বোনেরা মূল আলোচনায় ফিরতে বাধ্য হয়। হ্যাঁ ওই যে বলছিলাম আজকের খবর নদী। নদী ওঁদের চোখে কেমন মেয়ে ,মা ,বধু। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরে ওরা গোমুখ বেড়াতে গিয়েছিল বাবা মায়ের সাথে। পথে র সাথী নদী। চিরবাসা নামে একজায়গায় খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটতে লাগলো। ভুজবাসা তে রাত্রি বাস। জ্যোৎসনা ভেসে গিয়ে পাহাড় কে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। পরের দিন গোমুখের উদ্যেশ্যে রওনা। কুলকুল বয়ে চলছে আপন বেগে আপনহারা মাতোয়ারা স্বচ্ছতোয়া । নদীর  বয়ে যাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি রূপে ধরাদিয়েছে। এখানে ই নদী নারী। যে না থাকলে সৃষ্টি থেমে থাকত। কিছুদূরে দেখাগেলো জলের উপর বরফের টুকরো ভেসে ভেসে চলেছে। এর মধ্যে খুঁজলো নারীর ধারণ ক্ষমতা। গর্ভে যেমন ভাবে সন্তান কে বয়ে নিয়ে চলে তাঁর মা ,ঠিক যেন তেমনই ,কোনো ভার লাগেনা মায়ের মতো। চলতে চলতে নদীর উৎস স্থল গোমুখের সম্মুখে। এ যে নারীর সম্পূর্ণ রূপ। কন্যা -বধু -মাতা। সর্বং সহা। পাথরে ধাক্কা খেয়ে এঁকে বেঁকে নদী প্রতি বন্ধকতা কে ভেঙে নিজের গন্তব্যে পৌঁছচ্ছে। এই হল নারী শক্তি। যতই বাধা বিপত্তি আসুক নারী পৃথিবীর নাড়ির স্পন্দন।
---------আজ মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। রুনু আর ঝুনু  আজ দুষ্টুমী একটু বেশী মাত্রায় করছে। ওদের শান্ত করার একটাই ওষুধ।  ওষুধ  গান।বাইরে বৃষ্টি ঘরে রুপু গাইছে "এমন দিনে তারে বলা যায় "কি সুরেলা কণ্ঠ। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। পরপর গেয়ে চলেছে,"নিবিড় মেঘের ছায়ায় মন দিয়েছি মেলে "ওগোপ্রবাসিনী "যখন গাইছে মনে হয় যেন সে কোন সুদূরে বসে শুনছে এপারের কথা। আহা। ওঁরাও আজ স্তব্ধ। বোনে বোনে আজ কথায় গানে রবিঠাকুর এর গানে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়,সুবিনয় রায় ,আশীষ ভট্টাচার্য থেকে ঋতু গুহ।  বেগম আখতার থেকে গুরুদাস মান ,দলজিৎ ,অরিজিৎ সিং।এর মাঝে রুনু ,ঝুনুর প্রিয় গান বাজানো এবং ওদের swag নাচ হল। digy bom bom .এই ওষুধ পড়েছে ব্যস আর চিন্তা নেই। মুসুদের কথায় আর বিরক্ত করবে না ওরা।
রবীন্দ্রনাথের গানে এই প্রাতঃস্মরণীয় দের চিন্তা ধারায় রূপু অনুসরণ করে। অনুকরণ করেনা। বেগম আখতারের "মেরে চেহেরে সে গম "গানটি প্রায় গাইতে চেষ্টা করে। চেষ্টা করে ঊর্দু উচ্চারণটা সঠিক করতে। আর দলজিৎ থেকে অরিজিৎ গান চালিয়ে মুসুর কথ্থক নৃত্য। সে যেন দেখেও আর শুনেও শান্তি। ওরা সবাই খুব আনন্দে থাকে। সব খুশির মাঝে দুঃখ এলেও ভেঙে পড়েনা পরিবারটি। মুসু ,রূপু  এখন শিক্ষক। একজন নৃত্যের এবং একজন সংগীতের।
----আজকে ওঁদের রবিঠাকুরের নারী শক্তির বিন্যাস চলছে। রুনুঝুনু সামনের পা দুটি টানটান করে মেলে দিয়েছে। এ যে গভীর বাণী তাই উঁচু হয়ে আছে তাদের শ্রবণ যন্ত্র দুখানি।বিষাদ ,আনন্দ ,অবকাশ এমনকি অবসাদে যাঁর শব্দের ভীড় নৈঃশব্দে কথার সমৃদ্ধি ঘটায়। অপ্রকাশ মেঘে  কখন যে স্বপ্রকাশ র রোদ্দুর আনে বোঝা কঠিন। মেঘের বিকেলে মন কেমনের রসদ। রাতের স্বপন গুলো যখন মোহে অজানায় মিলিয়ে যেতে চায় তখন তাঁর শক্তি ঠাওর হয়। রুনু ঝুনু দুই দিদির ভাষায় সড়গড়। আজ ওরা চুপটি কোরে লক্ষীটি।
পাহাড় ,নদীর মিলন এর সৃষ্টি ঝর্ণা। সে চঞ্চল কিন্তু মধুর। পাহাড়ের অহং নদীর শান্ত রূপে আর কলধ্বনিতে মজে যায়। প্রকৃতির দৈনন্দিন ওঠাপড়া যেমন সহজে নজর আসেনা কিন্তু সমস্ত টাই তাঁর দেওয়া। তেমনি নারী শক্তির দর্শন রবি ঠাকুরের সৃষ্টি যা জীবনের ওঠাপড়ায় সমৃদ্ধ ঘটায়। বাসব দত্তা প্রতিকারে ব্যস্ত ,পুরী দর্শনের পরে রানীর অসহনীয় এবং প্রমোদ প্রিয় যেমন ঠিক তেমনই তাঁর সহচরীর নিষেধ এক অন্য মাত্রা আনে। চিত্রাঙ্গদা নারী জাতির পুরুষ ও নারীর মেলবন্ধন যা প্রত্যেক নারীর নাড়িতে। প্রকৃতি সে নিজেই সংস্কারক। কুন্তীর মাতৃত্বের স্বীকারক্তি। রক্তকরবীর নন্দিনী।  সবই মেয়েদের শক্তি যেখানে লুকানো কিছুনেই। ঘরে ছয় টি নারী একটি পুরুষ মুসুদের। সেই বাবাকেও তাঁরা তাঁদের সম্মান দেয় এবং বাবাও ওঁদের মান দেন্।রুনুঝুনু ও সদস্য ।নিমন্ত্রণ বাড়িথেকে ওদের খাবারের বাক্স আসে।
বাইরে আষাঢ়ের পূর্ণিমা, জানালা দিয়ে জ্যোৎস্না ভেসে আসছে একজন গাইছে, "ও আষাঢ়ের পূর্ণিমা" আমার আর অন্য জন নৃত্যের আবেশে, আর ওনারা জুলজুল করে চেয়ে আছে। দিম্মি ঠাম্মি ওদের সমালোচক।  মায়ের ভাবনা মেয়েরা তো বড় হচ্ছে। স্বাবলম্বীর পরে পাত্রস্থ করতে হবে। আর বাবা ভাবছেন এমনি করে যায় যদি দিন যাক না। মেয়েদের ,বাবা ঘরের আড়াল করতে চাই না। বন্ধুদের মেয়েদের পাত্রস্থের  পূর্বের  ও  পরের অবস্থান এ কয়েকটি পরিবার তাঁর কেমন যেন ঠেকে।
--------আজকে সন্ধ্যেটা বড্ড আনচান করছে তাঁর। একবার ঘর একবার বাহির করছে। পায়ে পায়ে লটা পটি  করছে রুনুঝুনু। তবুও সন্ধ্যে বাতি দিয়েছে। রাত ক্রমশঃ বাড়ছে। ওঁদের বাবাও ফেরেনি এখন ও। আর দুই বোন ও ফেরেনি আর ফেরার সময় ও হয়নি। বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছে। আজ রান্না করতে বারণ করেছে মেয়েরা আসার পথে খাবার নিয়ে আসবে।আজকের রাতে জোছনার আড়ি। গাঢ় আঁধারে দিক শূন্য। মায়ের ভাবনায় আত্ম বিশ্বাসের সুগন্ধী ভরপুর।  দিম্মি ঠাম্মিও দৃঢ় মানসিকতার।  মনোস্কামনা মিষ্টতায় আচ্ছন্ন। স্বভাবে সততা ,প্রায় অর্ধেক জীবন গোলাপের মধুরতায় ভরা। সবই তাঁর দুই কন্যা ঘিরে। ওরাই পৃথিবীর দুই গোলার্ধ। অনেক ঘাটতি জীবনের মুশকিল আসান ওই মেয়েরা। জীবনের অর্থ বহ সময় চলে গিয়েছে অনেকে বলে এটা করতে পারতে ,ওটা করতে পারতে। কিছুতেই কান দেয়নি ,তাঁর ভাবনা ছিল জীবনটা আমার ,কেমন চালাব সেটা নিতান্ত নিজের। হাওয়া কখনো এক দিকে বয় না। এখন যেদিকে বইছে সেইদিকেই বইব এই চিন্তা ধারার ওদের মায়ের। এখন শুধুই এঁরা। উদাস হাওয়ায় মন কে পাখি ভেবে কত ভাবনা আষ্টেপৃষ্টে এই মুহূর্তে। সারাজীবনের পাওয়া না পাওয়া সব কিছুই ইচ্ছে র আকাঙ্খা। সেখানে কোনো দুঃখ এবং কম বা বেশী পাওয়ার নয়। কাঁটার আঘাতে ফুল কোনো কলঙ্কর ভাগীদের হয়না। কিন্তু ফুল যখন চুপচাপ আহত করে তখন ই সইতে পারা দুঃসহ। কত কী ভাবনারা কি হাওয়ায় মাতাল আজ অন্য সমীরণে। নিকষ আঁধারে একলা পথিক চলতে চলতে ওই পথ হারালো বুঝি। শুনিস নি  কি শুনিস  নি তার পায়ের ধ্বনি  গানটা হঠাৎ গলায় সুর পেলো। অনেকদিন পরে নিজের জন্য সময় এলো কাছে। গান শেষের ক্ষণেই দরজায় টিংটং।বিধ্বস্ত  দুই মেয়ে। খানিক বাদে ই ওদের বাবা। রুনুঝুনুর চঞ্চলতা খুব বেড়ে গিয়েছে।ঠাম্মিরা খুশী ওরা অক্ষত।
-----মুসু আর রূপুকে খুব তৃপ্ত লাগছে এখন। অনুষ্ঠানের পর ওরা রাত  আটটা  র মধ্যেই ফিরছিলো। একেতো অন্ধকার তার মধ্যে টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি পড়ছে। রিকশা নিয়েছিলো। মা বলেছিল তাড়াতাড়ি ফিরতে। সেই সকাল থেকে কুর্চির বাড়িতে। খুব আনন্দ করেছে। কুর্চিদের বাড়িথেকে আসতে একটা মাঠ পেরোতে হয়। ওখানে এখন সমাজ বিরোধীরা ভীড় জমায়। মুসুদের যাওয়া আশা করতে দেখে প্রায়। কিছু বলেনা ওরা । রিকশাতে ফিরতে ফিরতে দুই জনে ভয় কাটানোর জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কেও কথা রাখেনি জোরে জোরে আবৃত্তি কোরে চলেছে। রিকশা কাকুও চেনা। কাকুও বেশ গতিতে চালাচ্ছে। কবিতা শেষ হতেই মাঠ পেরোনোর মুখে গোঙানির শব্দ। কেও কাওকে ছেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে শব্দ আসছে। দুই কন্যা বরাবরের ডাকাবুকো। বলে ,কাকু রিকশা থামাও। সেতো শুনবেনা ,বলে তোমার মা বলেছে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছেদিতে তোমাদের। ওরা নাছোড় বান্দা। এক লাফে নেমে শব্দের হাওয়ায় এগিয়ে চলেছে। পিছনে রিকশাতে তালা দিয়ে কাকুও। দেখে দুই টি ছেলে মেয়েটিকে মুখে ওড়না গুঁজে দিয়ে হাতে পিছমোড়া করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এরাও উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ক্যারাটে র ফাঁদে কাত কোরে ফেলেছে। দুই বোনে দুই জনকে উত্তম মধ্যম। আর রিকশাকাকু মেয়েটিকে বাঁধন মুক্ত করছে।
দুই বোনের ক্যারাটে শেখা আছে। ওরা সব সবুজ ,কালো বেল্ট ও পেয়েছে এই প্রশিক্ষণে। তার মধ্যে দুই বোন কেশবতী কন্যে। ওরা চুলের বন্ধনীতে সবসময় ধারালো বক ক্লিপ রাখে। চাণক্যর ন্যায় দণ্ডের মতো ওরা বয়ে চলেছে ক্লিপ।
প্রথমে কুপোকাত কোরে ,শরীরের নানান জায়গায় বক ক্লিপের চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। শয়তানরা  যন্ত্রনার  পাথারে কুল খুঁজে পাচ্ছে না। মেয়েটিকে নারকীয় অত্যাচার থেকে বাঁচিয়ে ,একটা মানুষের মত কাজ করেছে।
মেয়েটি জানায় যে বাড়িতে ওর ছোট মেয়ে আছে ,মা আছে আর নেশা খোর স্বামী আছে। সেই ভোর বেলা রান্না করে ,ওদের খাবার গুছিয়ে ,মেয়ের স্কুল এর সব গুছিয়ে এখানে হাসপাতালে আয়ার কাজে আসে। আজ কে ডিউটি বদলাতে দেরী হয়েছে। দুটো পয়সা বাঁচানোর জন্য আজ প্রায় ছুটতে ছুটতে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছিল। নইলে এই বাস চলে গেলে ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা হয়ে যাবে। স্বামী সন্দেহ করবে ,নেশা করবে ,পেটাবে। মেয়ের সামনে গালাগাল পারবে।
-------মুসুদের সঙ্গে মেয়েটি এসেছে। ওর আজ বাড়ি ফেরা হয়নি লাস্ট বাস চলে গিয়েছে। ওর সম্মান রক্ষা হয়েছে আজ। স্বামী যতই মারধর করুক ,গালমন্দ পারুক। মেয়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে ,কিন্তু ওর দিদা সব সামলে নেবে। দিদা এবং নাতনী মালতীর সহায়। মেয়েটির নাম মালতী।
আকাশ যেমন ছিল তেমনই আছে ,শুধু মনের আকাশে আঁধার। অংক ,ফলাফলে কবিতার মত ছন্দে ঝোরে পরে মিলনের সাথে ,জীবনের যোগ বিয়োগে দেহ মনে উথাল পাথাল। সূর্যের আলো কোথাও কম পড়েনি ,মনের আলোকপাত এ আজ খানিক কম পড়েছে।জ্যোৎসনা মাখানো মায়াবী রাতে সুরের বন্যা ভাসানো ভেলায় আজকের যাত্রীর হৃদয় অমাবস্যার ঘরকন্যা। ব্রহ্মান্ড জুড়ে নক্ষত্রের পসারী ,কিনবে যে মন সেই মন আজ কে শুধুই ভিখারী। মালতীর মনে আজ কী ঘটে চলেছে তার টের পাওয়া যাচ্ছে অসহায় চোখের চাহনি তে। মুসুদের বাড়িতেও চলছে মনের দুর্যোগ।
আজকে মুসু ,রূপুদের বাড়িতে আকাশের যেমন করে গাওয়ার কথা তেমন ভাবেই গাওয়ার কথা ছিল ,কিন্তু আজ বেসুরো পরিবেশ। ওঁরা কোথাও থেকে ফিরে কত গল্প জুড়ত আর শ্রোতা ঠাম্মি ,দিম্মি , বাবা ,মা ,রুনু ঝুনু। বিশেষ আকর্ষণ রুনুঝুনুর টানটান পা মেলে জুলজুল চোখে চাওয়া আর মাঝে মাঝে একটা মিষ্টি আওয়াজ। আজ কিছুই নেই। আজকের শুধুই মালতী। মালতী বলে ওর প্রিয় কবি  জয় গোস্বামী। প্রিয় কবিতা বেণীমাধব তোমার বাড়ি যাব। আরও বলে কবির র মালতী সেলাইয়ের দিদি মণি আর এই মালতি হাসপাতালের আয়া রাণী। রাণী কথাটা বুঝেই বলেছি দিদি ,কোন কাজকে ছোট ভাবিনা ;এর বিনিময়ে আমার সংসার চলে। বলতে বলতে হঠাৎ বলে --অভাবে আমিও "যদি নষ্ট মেয়ে হই "...
জানো আমিও তোমাদের মতই বড় হচ্ছিলাম। বাবা ,মা খুব স্বপ্ন দেখত আমাকেও দেখাত ,একদিন বড় হব ,নিজের পায়ে দাঁড়াব। কিন্তু মন যে বাতাসের থেকেও চঞ্চল। সেই দিন ,যেদিন আমি এই ছেলেটার কথায় এক কাপড়ে বেড়িয়ে এলাম।  একই কলেজে দুজনেই পড়তাম। আমার কবি জয় আর ওর শক্তি চট্টোপাধ্যায়। আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলত ,"মালতী বাড়ি আছো "? কী মোহ যে সেই থেকে ঢেকে ছিল ,সেই কুয়াশার জাল কেটে আজও বেড়োতে পারিনি। শুরুর দিনগুলোতে আকাশে মেঘেরা গাভীর মত চড়ে বেড়াত ,আজকে সেই মেঘেদের দেখা পায় না দুজনেই। কত কথা ছিল দুজনের রাখার ,ও কথা রাখেনি।  মেঘ জমলে দুজনেই গাইতাম "আজ যেমন করে গাইছে আকাশ "--এখন মনে সবসময় ঘন নিকষ আঁধার। সকল  মুখর ভাষার নীরব যন্ত্রণার ছটফটানি আজ  ঝড়ের তান্ডবে তছনছ সংসারে।
বিচ্ছেদ ,বেদনা দেহ থেকে মনে ওই ধরিত্রীর সুতোতে বাঁধা পড়েছে। ধরিত্রী আমাদের মেয়ে। এই মালতী আর শক্তির একমাত্র আকর্ষণ। শক্তি নেশাড়ু কিন্তু ধরিত্রীর কাছে একান্ত ই বাবা। নেশা কাটলে বাবার আর মেয়ের স্নেহ সুরের আর বাণীর  অদৃশ্য সুতোয় মেল্ বন্ধনে  দিগন্ত বিলীন। ধরিত্রী জানে শক্তির নেশা ,কিন্তু বাবা যখন কবিতা বলে তখন যেন মন্ত্রমুগ্ধ। এক নাগাড়ে বলে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল মালতী। কথার পাকে রাত গড়িয়ে সকাল। আজ মালতী হাসপাতাল যাবে না। আজ বাড়ী যাবে সোজা।
-------চিন্তা তে রাত্রে কেও দুচোখের পাতা এক করেনি। বাড়ী পৌঁছতেই সকলের আনন্দ। সাথে আরও দুই কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। শক্তি আজ সংযত ,কাল রাতে নেশা কাটার পরে অনুভব করেছে একা এবং একান্তের অর্থ। তাঁর অনুভবে "আমরা সকলেই যাত্রী ,ভ্রমণের চাবিকাঠি একজনের হাতে। কোথায় থামতে হবে আর গন্তব্য কোথায় সেই জানে। একলা সাথী হলে সমাজে র বড় শাস্তি ,একান্ত আশীর্বাদ এবং শান্তি আরামের। একলা ,ছটফট করায় কিন্তু একান্ত শুধুই অনুভবের। মন এ আজ  মূল্যবোধ। পুলিশ ছাই এর দড়ি পাকাতেও পারে। কিন্তু সেই ছাইয়ের দড়ি পাকাতে গুটিকয়েক মানুষজন ও ওস্তাদ। নির্যাতিতা বাড়ি ফেরায়    উৎসাহীর আনাগোনা  বেড়েছে। আজকে শক্তি সেই আগের মতই ,বলে 'মালতী বাড়ী এসেছ ,তুমি কি আগের মতই আছ নাকি খানিক বদলেছো"। যা আছো আছো ,তুমি আমার ই আছো।
আজকের খবরের কাগজে দুই দুষ্কৃতির অপ কম্ম এবং পুলিশ হেফাজতের খবর বেরিয়েছে। নির্যাতিতার নাম পরিবর্তিত এই লেখা আছে। রূপু মুসু দের বাড়ি থেকে কথা বলেছিল মালতী বাড়িতে ।শক্তি ও মালতী বিশ্বাস করত বীজ ভালো হলে গাছ ভালো হবে। মাটির ওপর নির্ভর করে জলের স্বাদ মিষ্টি না নোনতা হবে।বীজ আর মাটির যত্নে আজ ধরিত্রী।
গাছটিতে ভালো জল ,সার দিতে হবে। ভবিষ্যতের সুন্দর ফুল ,ফলের আশায়। ধরিত্রীর স্কুলে  ভূগোল শিক্ষিকা র হিমালয়ের বর্ণনা শুনতে শুনতে ধারণা তৈরী করেছিলেন ওঁর মনে। হিমালয়ের বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় এখনও অনেক চলতে হবে। ওই বিশালাকার এর সামনে আমি অতি ক্ষুদ্র। ওঁর বাবার নেশার সময় অগোছালো কথা মনকে পীড়া দিত। পীড়া দিত বসবাসের পরিবেশকে। পড়াশোনায় ভালো ,বিদ্যালয়ে আবৃত্তি ,গানে তার প্রশংসা। বাড়িতে বন্ধুরা আসতে চাইলেও ও আনেনা। বন্ধুরা যখন ওদের বাড়ির  ,গাড়ির কথা বলে তখন ও শোনে। আনমনা হয়ে যায় ,ওরা বলে তোর বাড়ির কথা বল?ধরিত্রী ওর মায়ের কাছে শুনেছিলো এক হত দরিদ্র মহিলা ,যার বাড়ির চাল ফুটো ;বৃষ্টি হলে জল পড়ে ঘরে। আবার জ্যোৎস্না হলে ওই ফুটো চাল দিয়ে ঘর আলো করে। জ্যোৎসনার  কথাটা মনে বড় ধরেছিল সেদিন। আজ বন্ধুদের ধরিত্রী বলে "আমার বাড়িতে জ্যোৎসনার আলো আসে প্রতি মাসে ,তোদের বাড়ি তে জ্যোৎসনা আসে ?"---
ধরিত্রীরা এ খানে থাকবে না। ওদের গন্তব্য মুসুদের বাড়ী। সেখানে একখানা ঘর বাথরুম আছে কোন ভাড়া লাগবে না। ওদের আবাসনের দেখ ভালের ভার এখন মালতীদের।
এখন মালতী রা খুব ভালো আছে। মালতী ওর নিজস্ব আয়া কেন্দ্র খুলেছে তার প্রশিক্ষণ দেয়। পাশেই একটা ঘর ভাড়া নিয়েছে। সেখানে শক্তি কবিতা শেখায়। ধরিত্রী এখন গান ,কবিতা,নাচ শেখে।  পুরোনো সেই বাবাকে ধরিত্রী খুঁজে পায়। একবার ছোটতে  ধরিত্রীর বার্ষিক পরীক্ষার ফল খারাপ হয়েছিল। বাড়ি এসে খুব কেঁদে ছিল। বাবা তখন নিজেই ধরিত্রীর একটা ভালো খারাপের রেজাল্ট তৈরী করে ছিল। সেখানে ধরিত্রী মানুষ হিসেবে কেমন ?  প্রত্যেকটাতেই  অসাধারণ। এভাবেই চলত। অভাবে বাবার বিপথ অবলম্বন। এখন বাবা আগের মতন।পাড়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। মুসুদের সাথে অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে। ধরিত্রীর বাবা মা ও অংশ নেয়।ওরা এখন বসুন্ধরা আবাসনের। 
ওদের বীজ এবং মাটি দুটোই উর্বর ছিল। তার ফল ধরিত্রী।  মুসুরূপুদের বাড়ির দেখভালে ধরিত্রী আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। যে মানুষরা একদিন অবহেলা করে ছিল তারাও এখন আই পি এস ধরিত্রী রায় এর আত্মীয় নামে পরিচয় দেয়। ধরিত্রী চেয়েছিল ব্যতিক্রমী হতে। সেটা পেড়েছে।  চাকার ওপর নীচের ধারাবাহিকতা এবং ভাগ্য ,দুইয়ের সংমিশ্রণের সক্ষমতা ই    ব্যতিক্রমের পথে অতিক্রম। ............