Tuesday 25 December 2018

ছিন্ন বীণা

ছিন্ন বীণা

বীণা যখন তারের টানে ,
বিষম ব্যথা গানে গানে।

গান খানি  তাই বাঁধব বলে,
নিন্দা-দোষারোপ  রসাতলে।

চিন্তায় জ্বলে চিতার আগুন,
মিশব তখন কালের দ্বিগুণ।

বাঁচতে চাওয়াই,ব্যথা পাওয়ায়,
যেমন করেই , বাঁচার আশায়।

বেঁচে থাকি জীবন গানে,
হোক না বীণা ছিন্ন প্রাণে।।।

             ...মৌসুমী রায়।।

Friday 21 December 2018

একলা..

একলা ..

ভালোবাসার গভীর টানে
থাকুক কিছু সংগোপনে।

নীরব চোখের চাহনী খানি
বাজুক বুকে বেদন আনি।

মুখোমুখি বসিয়ে যাপন দুজন
গাইবে  মনে কোকিল কুজন।

স্বপ্ন গুলো বাঁধবে যখন মন
সুতোয় গেঁথে নিও শুভ ক্ষণ।

তোমায় নিয়ে গায়বে কত গান
সেদিন দেহে থাকবে না  প্রাণ।

মৌনতায় জ্বালিয়ে নীরব বাণী
পিছের টান মিছের তরীখানি।
                      ...মৌসুমী রায়।

Wednesday 19 December 2018

শুভেচ্ছা

শুভেচ্ছা

অনেক দিনের পরে যেন তৃপ্তি এল।
নীরব রা তোমার লেখায় মুখর হোল।।

নিত্য নতুন কলম ছেঁচে রস টুকু দাও।
কাগজ পথে  প্রতিদিন ই শুভেচ্ছা গাও।।

বৃষ্টি শেষে নূতন প্রাণের আনাগোনা।
নতুন ভোরের বার্তা দিল ঊষার কণা।।

ভোরের দোর টি খোল  যখন ডাকে ।
ছোট্ট বেলার কথা মনে মনে আঁকে।।

ফিরিয়ে দিলে প্রভাতী ভালোবাসার রশ্মি।
শুভেচ্ছা নাও ,বৃষ্টি ধারায়  সিক্ত সুস্মি।।
                             . ..মৌসুমী রায়।।।।।

Tuesday 18 December 2018

সই

"সই", প্রতিলিপিতে পড়ুন : https://bengali.pratilipi.com/story/RgmGr5kIR4LQ?utm_source=android&utm_campaign=content_share সংখ্যাতীত রচনা ভারতীয় ভাষায় পড়তে, লিখতে এবং শুনতে পারেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে

লবণ

"লবণ", প্রতিলিপিতে পড়ুন : https://bengali.pratilipi.com/story/GztjRVoCWpvG?utm_source=android&utm_campaign=content_share সংখ্যাতীত রচনা ভারতীয় ভাষায় পড়তে, লিখতে এবং শুনতে পারেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে

Monday 17 December 2018

সই...

#সই
#মৌসুমী রায়

শিশির ধোয়ায়
স্বচ্ছ তোয়ায়
পথের ধারে
নদীর তীরে
ঝুমকো লতা
চিকণ পাতা
শীতের ভিড়ে
মুখের  পরে
ভাবছি কবে
লিখব ভেবে
তোল চিবুক
ঋণ মিটুক
ওই আকাশ
ভাব শেখাস
জলকে চল
সই রে বল
তোর যত
গুণ এত
নেই ওরে
মোর তরে
বল রে বল
মন উতল
এমনি থাকিস
কথা বুনিস
ক্ষীণ আশা
বাঁধব বাসা
মনে রাখিস
বাসতে থাকিস
অনেক দিনের
কোণে মনের
এই আশায়
পলক হারায়
সেই আমার
ছোট্ট বেলার
নতুন দিন
ভুলিয়ে মলিন
বাঁচতে চাই
বেলা যে যাই
বন্ধু আমার
হয়ে সবার
এই বসন্তে
ভাবি একান্তে
সই এর গুণে
মুগ্ধ প্রাণে।।

Friday 7 December 2018

#চড়ুই টি...

#চড়ুই টি..

#মৌসুমী রায়

আমাদের ফ্ল্যাটের বারান্দায় এখন ওরা ছোট্ট বাসা বেঁধেছে।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গায় ওরা শব্দ কোরে।
ঘর বাঁধার সময় বারান্দা নোংরা করত। বেশ লাগত।কত্তা গিন্নি আমরা ওদের নিয়ে দশ মিনিট সময় যাপন করতাম।
মাঝে মাঝে ঘৃতকুমারী গাছে বসে কিছু খুঁটে খায় ,  একবার বসে ; আবার ফুরুৎ কোরে উড়ে যায়।
ওদের চঞ্চলতা মনকে আনমনা করে দেয়। বলে ,অনেকদিন তো আকাশ দেখা হয়নি , একবার টি দেখ চেয়ে কত বিশাল।
মনটাও বড় এক কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে কী? ওঁরা জানতে চায়।
ঘরময় ওদের আনাগোনা চলে ।
জামাকাপড় এ মাঝে মধ্যে দোলখায় আর ইয়ে(বিষ্ঠা)  করে।
কচি লঙ্কা গাছের পাতা গুলো কুট কুট করে খেয়ে ফেলে। খুব মন খারাপ হয়। আবার মন ভালো হয়ে যায় কিচিমিচি শব্দে। কখন কখন রোদ্দুরে পাখা মেলে ধরে।
ঝাপটে পালক গুলো ঝরে পড়লে ,রক্ত করবীর নন্দিনীর রঞ্জনের আগমনের কথা মনে আসে।
সাথে সাথে আমার বাড়ির সুখবরের আশায় আশায় রই। ফলেও যায় । কত যে আছে ওঁদের কথা  বলেও শেষ নাহি যে  কি বলব।

আবার ফুলের টবের মাটি গুলো খুঁড়ে ছড়িয়ে দেয়।
দুপুরে ভাত দেওয়া হয় ওঁদের।
খুঁটে খুঁটে খেয়ে ফেলে।
বিশ্রামে একজন অন্য জনের পালক ঝেড়ে দেয়।
দেখলে মনে হয় ,সোহাগে আবেশে আপন হারা।।

তোমার আবেশে আমার মন ও আপন হারা।

শুধুমাত্র  সাধ ,ওঁরা কিচিরমিচির করে কী,ইচ্ছে করে শিখে নি।।।।

Wednesday 24 October 2018

ওপার হতে 
#মৌসুমী রায় 
 আগুন কে মনে পড়ে ফাগুনের  আগুনে ,সোনা সেতো সোনা হয় পুড়ে গেলে আগুনে। গানের কলি টা আজ সকাল থেকে গেয়ে চলেছে অসীমা। আজ চল্লিশ বছর পার করে বাবা আর মায়ের সঙ্গে আবার একসাথে। এর পূর্বে আঠেরো বছর একসাথে ছিল ওরা তিন জন। এখন অসীমা আটষট্টি। কিন্তু গলাটা সেই আঠেরোর মতো।

 গান শেখানোর ক্ষমতা বাবার ছিল না। অসীমা রেডিও তে  শুনেই তুলে নিত গলায়। বিশেষ কোরে ,বিকেলে ছায়াছবির গান ,রেডিওতে পরিবেশন এর সময় খাতা ,কলম নিয়ে হাজির থাকত ও।  পড়া লেখাতেও ভালো ছিল। সবই ,অর্থের অভাবে  বন্ধ হতে বসেছে। তখন এক চাকুরী জীবি পাত্রের সন্ধান এলো । প্রায় কুড়ি বছরের বড়। প্রথমে আপত্তি থাকলেও। ছেলের বাড়ি থেকে বলে অসীমা কে, ওরা পড়াবে ,গান শেখাবে যতদূর-- অসীমা চাইবে।
 বাবা কৃষক ,জমি চাষে, যা আসে; সেটাই কুলোয় না। এমন সুপাত্র কেও ছাড়তে চাই। পাত্ররা দুই ভাই আর এক বোন। আর মা। বাবা গত হয়েছেন। বাবার চাকরীটা বড় ছেলে পেয়েছে।তার ওপর শহরে বিয়ে হবে। মেয়েটা খেয়ে ,পড়ে বাঁচবে। বাবা তো,মেয়ের সুখের কথা ভেবে রাজি।
গ্রামের   এর ওর ,সাহায্যে বিয়ে সম্পন্ন হল।
 প্রথম কয়েক মাস অসীমার  আনন্দের সীমা নেই । প্রথমে বাপের বাড়ি খুব আসত। ইদানিং আসা যাওয়ায় খামতি ঘটেছে। বছর খানেক হল বিয়ে।স্বামীর রাত্রে ডিউটি থাকলে ,ননদ অসীমার সাথে থাকত।
----
অসীমা ,খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে বাবা ,মায়ের সাথে গল্পে মশগুল। মা একটা বলে ,বাবা একটা বলে। আহ্লাদে আট খানা।  অসীমার পোড়া জায়গাটা শীত কালে টান ধরে।আর শ্বশুর বাড়ির কথায় পোড়া জায়গা টা জ্বালাপোড়া করে।

 ভাদ্র মাস চলছে। মাস গুলো অসীমা ওঁর বুদ্ধিতে, চির বসন্তের দেশে ,গুনে গেঁথে  ঠিক করেছে।
এই ভাদ্রে পুজো আসার আগে ,অসীমার মা ,মাটির বাড়িটা নিকিয়ে ,চুকিয়ে ঝকঝক কোরে তুলতেন। চতুর্থী তে মাটির দেওয়ালে খড়ি মাটি দিয়ে চাঁদ আঁকতেন। অসীমা ,গিরিমাটি দিয়ে চারদিক টা বর্ডার দিত। বাড়িতে কুসুমফুলের বীজ ,ছোলা দিয়ে হলুদ চালভাজা ,মুড়ি ,মুড়কি ,নারকেলের নাড়ু তৈরী করতেন মা। খুব মজা। আর শুক্র বার করে রহমান চাচা গ্রামে নতুন জামা ,কাপড় বিক্রি করতে আসতেন। অসীমার একটা লাল সাদা ফুল কাটা ফ্রক কেনা হতো। মা ,বাবার তেমন কিছু কেনা হতো না। জিজ্ঞেস করলে বলতেন ,"তুই পড়লেই ,আমাদেরও পড়া হবে..... "পুজোর পরে বিজয়াতে জামার আঁচলে, নাড়ু ,মুড়কি আনতো অসীমা ;বাড়িবাড়ি বিজয়া কোরে।

অগ্রহায়ণ এলেই অসীমা ,পুতুলের বিয়ের আয়োজন করতো। ওঁর যে বার মেয়ের বিয়ে দিতে হতো ,সেইবার পণ এর আয়োজন করতো। সে এক মজার। অসীমাদের বাড়িতে ,কুটুম এলে; বিদায় কালে পাঁচ -দশ পয়সা দিয়ে যেত। অন্য সময় বাবা ,মা কে দিয়ে দিত। কিন্তু ,ওঁর মেয়ের সময় পণ দেওয়ার জন্য,আচার লজেন্স কিনতো। লজেন্সের সাথে নকল দু ,পাঁচ টাকার নোট দিত। সেই টাকা গুলো পুতুলের শ্বশুর বাড়িতে পণ হিসেবে দিত।

অসীমা এখানে বড়ি দিয়ে বেগুন আর আলুর তরকারি খেতে পায়না। আর পায় না মাছের টক।
এখানে চির বসন্ত। রোদ্দুর তেমন নেই ,বড়ি ভালো শুকোয় না। আর ,পুকুর থাকলেও মাছ চাষ হয়না। কারণ মাছ থাকলে ,এখানে থাকা যায়না। পুকুরে পদ্ম ফুলে ভোরে আছে। সেখানে সাঁতার ও কাটতে পারেনা অসীমা।
পৃথিবীর মত সুন্দর ,কোথাও নেই। সেই দেশ ,সে জন্মভূমি ,তাঁর মাধুরী আলাদা।
তবুও এখন বাবা ,মা কাছে আছে। অসীমা, মেয়ের জন্য সুস্থ ,দীর্ঘ জীবন কামনা করে। জামাই আর মেয়ের শ্বশুর বাড়িটা ভালো হয়েছে। নিশ্চিন্ত ,বাবাঃ।

ছেলের বাড়িথেকে পাকা কথা হোল। পণ দিতে ,অসীমার বাবাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। চাষের জমি বিক্রি করতে হয়েছিল। বিয়ের পরে থেকে দুবেলা ,দুমুঠো খাবারের যোগাড় করতে হিমশিম খেতো ওঁরা।
এভাবেএকদিন অসীমা মাধ্যমিক এ ভালো ফল করল। আর পড়া হোলো না। গায়ের রং চাপা ,তাই খানিক পণ দিয়ে ওঁর বিয়ে হোল।
মাঘ মাস এলেই শ্বশুর বাড়ির টাটকা সুখের কথা মনে পড়ে। তখন প্রথম প্রথম নতুন শাড়ি ,গয়না সবই পড়ত। আত্মীয় দের বাড়ি প্রথম একবছর যাতায়াত করত। আর ,একটা দেখত প্রায় প্রতিমাসেই একটা কোরে জীবনবীমা করত স্বামী। অসীমা আপত্তি জানালে বলত ওঁরা ,তুমি এ বাড়ির লক্ষ্মী ।
 বছর দুই  পর থেকে আপত্তি ,অভিমান কিছুই ধর্তব্যে আসতো না। এরমধ্যে অসীমা র  কোল জুড়ে এক কন্যা সন্তান।
ওদের ধারণা ছিল ,ছেলে আসবে। অগত্যা মেয়েই সই।
এখন ও জীবনবীমা কিন্তু অসীমার নামেই। জীবনধারণের উপায় গুলো দূর্বিষহ অসীমার। পেটভোরে খাবারটাও দূর অস্ত। অসীমা বুঝেও ,বুঝে ওঠে না। কারণ ,মেয়ের মুখ চেয়ে। শ্বশুর বাড়ির এখন অনাদরের ধন মা ,মেয়ে।
লোকজন আসবে ,খবর পেলেই ;মা ও মেয়ের যত্ন খুব। তখন চিঠিদিয়ে আসতেন। সময় টা বেশ পাওয়া যেত।
অসীমাকে চিঠির  ভিতরের কথা জানানো না হলেও ,আদরযত্নের বহরে বুদ্ধিমতী মেয়ে বুঝে যেত। কিন্তু ,ওই যে ইদানিং কিছুই আর ধর্তব্যে নেই অসীমার। শুধু জীবনবীমার কাগজে সই ছাড়া।
সই করতে আপত্তি করলে ,মেয়েটার ক্ষতিকরার ভয় দেখাত ঠাকুমা ,কাকা ,পিসি। এমনকি বাড়ির আগের কাজের মাসিটা। এখন অবশ্য সবকাজ অসীমা করে।  এই সব আবার মনে পড়তেই অসীমার পোড়া গুলো ,আরও জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।
সেই ,দু বছর বয়সে মেয়েটাকে ছেড়ে এসেছে। তখনও ,মায়ের দুধ খেত। এখন অনেক বড় হয়েছে।স্বামী ,সন্তান নিয়ে সুখে আছে।
এখন যারা এপারে আসেন ,তাঁরা অসীমা কে বলেন ,খুশী ;মায়ের জন্য কাঁদে। মায়ের জন্মদিনে ,দুঃস্থ মায়েদের সাহায্য করে।

অসীমার ,শ্বশুর বাড়ি দূরে ছিল। এখন ওদের পাশেই।  স্বামী ,দেওর আর শাশুড়ি থাকে। ওরা যোগাযোগের চেষ্টা করলেও ,অসীমারা পাত্তা দেয় না এখন। অসীমারা ,তিন জন দিব্যি আছে। মেয়েটার শুভ কামনা করে ,দীর্ঘ জীবন আর শান্তি যেন পায় ;এটাই অসীমার এখন চাওয়া।মাঝে মাঝে শ্বশুর বাড়ির কথা মনে পড়লেই ,পোড়া দাগ গুলো বড্ড জ্বালাপোড়া করে।
এরা সকলে ,অসীমা কে ঘিরে রাখত ,লোকজন বাড়ি এলে। ফাঁকা সময় দেখে ,এক প্রতিবেশী কাকিমা কে কিছু বলার চেষ্টা করত অসীমা । কিছু বলে উঠতে পারত না। "কাকিমা "-----ডাক দিয়েই চুপ করে থাকত। চোখদুটো জলে ভরে উঠত।

বিয়ের বছর তিন পরে ,এক শীতের রাত্রে।
খুশী তখন বছর দুয়েকের। মামা বাড়িথেকে বিজয়া করে এসেছে। অসীমার বিয়ের পর এই প্রথম বাপের বাড়ি বিজয়া করতে গিয়েছিলো। পুজোর সেই ,ছোটবেলার আনন্দ।হলুদ  মুড়ি ,কুসুম ফুলের বীজ ভাজা ,ছোলা ভাজা ,কুমড়োর বীজ ভাজা দিয়ে ,নাড়ু নারকেলের ,সিড়ির নাড়ু ,মুড়কি অসীমার মা নিজে হাতে তৈরী করেছেন। অসীমা শাড়ির আঁচলে সর্ষের তেল মাখানো মুড়ি খেতে খেতে ,ছোটবেলার কথা অনর্গল বলে চলেছে। অসীমার স্বামী তুলনামূলক ভাবে শান্ত মানুষ। আর এখানে তাঁর মায়ের শাসন নেই। জামাই আদর যতটা পারেন অসীমার বাবা মা ,তার চেয়েও বেশী আপ্যায়ণ করছেন।
ছোট্ট খুশীকে মায়ের কোলে রেখে ,গ্রামের পরিচিত দের সাথে দেখা করতে বেড়িয়ে পড়েছে অসীমা। মোটে দুদিন থাকবে। তাই সব্বাইকে একবার দেখে যেতে চায় ও। এতো কষ্ট অসীমার ওখানে। কেও টের পাচ্ছেনা ওর আনন্দ আয়োজনে। পুকুর ধারের বটগাছটা ,কাশফুলের গোছা ,বিশু কাকা ,সব সব একবার কোরে বুড়ি ছোঁয়ার মতো ছুঁয়ে যাচ্ছে। অসীমার মনে হচ্ছে এই শেষ দেখা ,আর বুঝি হবে না। পুরোনো স্কুল থেকে খাল ,বিল সমস্ত জায়গা গুলোকে একবার দেখা করে। আহঃ কী তৃপ্তি ?
মা ,বলে আর থেমে যায় অসীমা। কিছু বলতে পারেনা। মায়ের সামনে সব ভালো ,ভালো আছি মা ;এমনটা দেখানোর চেষ্টা অসীমার। মায়ের মন কু ডাকছে। অসীমার এই ভালোটা শুধুই দেখানোর ,অন্তরের নয়।
আসা যাওয়ার ,কিছু বলা না বলার মাঝে বিদায় কালে অসীমার অঝোর ধারা খানিকটা হলেও বাবা আর মা কে ভাবিয়ে ছিল। খুশী কে কোলে নিয়ে বারবার পিছনপানে চাইছিলো অসীমা। ঠোঁট দুটো কাঁপছিলো ,এ কান্না তো সেই কান্না নয়।
পৌঁছানো পত্র সাতদিনের মধ্যে এলো। খুশীর গল্পে দাদুদিদার দিন কাটছে। খুশী ,অসীমার মেয়ে।
দিন দশেক পর অসীমার মা ,অসীমার বাবাকে বলছে ; একবার মেয়েটাকে দেখে এসো। মনটা বড়ই কু ডাকছে।
সেইমত জোগাড় যন্ত্র কোরে বাবা রওনা দিলো অসীমার বাড়ি। পুজোটা দেরীতে ছিল এবার। ঠান্ডাটাও এই কাত্তিকে বেশ জমিয়ে পড়েছে।
অসীমার বাবা ওদের বাড়ি ঢোকার মুহূর্তে দেখে পুলিশের গাড়ি ,আর লোকজনের জটলা। ভেবেছেন অন্য কোথাও কিছু হয়েছে বুঝি। কানে টুকরো কথা আসছে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে। আহারে ,মেয়েটা বড় ভালোছিলো ,বাঁদরের গলায় যেন মুক্তোর হার, এই ভাবে নির্যাতন  কোরে ,পুড়িয়ে মারলো। ঈশ্বর ওদের কখনও ক্ষমা করবেননা। জেল হবে ,ফাঁসি হবে। শুনতেশুনতে অসীমার্ বাবা বলেন ,কার কথা বলছেন আপনারা ? উত্তর শুনে পথশ্রান্ত বাবা সেই দরজার মুখেই বসে পড়লেন। বলতে থাকেন,হে ঈশ্বর ,আমার শিবরাত্রির সলতে টাও নিভিয়ে দিলে। ওঁর মা কে কী বলব।
-----

শীতের সেই রাত্রে অসীমার কাছথেকে খুশীকে ছল কোরে সরিয়ে নিয়েছিল ,শাশুড়ি ,ননদ আর দেওর। স্বামী ডিউটি তে ছিল সেদিন।মাঝরাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলতেই অসীমার মুখ চেপে ধরল দীর্ঘদেহী দেওর ,ননদ আর কাজের মাসি। কাজের মাসি  আগে ছিলো ,অসীমার বিয়ের পর বাড়ি ছাড়লেও যোগাযোগ ইদানিং বেড়েছিল।
দুজনে পিছমোড়া কোরে হাত বেঁধে টানতে টানতে বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে ফাঁকা মাঠে ,যেখানে সব আয়োজন ছিল ,সেখানে এনে ,পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে ,জীবন্ত দগ্ধ করে ওরা অসীমাকে। এক নিস্বাসে যেন সব শেষ হোলো। চুপিচুপি সেই রাতেই বাড়িতে এনে ,একটা আমগাছ ছিল সেখানেও আবার পোড়ালো।লোকজন কে বলা হোল নিজেই পুড়ে মারা গিয়েছে অসীমা।
 এপারে আসতে ,তিনবার পুড়তে হয়েছে ওকে। জিভের স্বাদকোরক গুলো আর নেই। মাছের ঝোল ,টক ,ঝাল প্রিয় ছিল অসীমার।উফঃ আর পারেনা। এখানে চির বসন্ত তাই রক্ষে।গরম হলে চিড়বিড় করত।
------
প্রথমে অসীমার হত্যা কারীদের কোন শাস্তি ই হয়নি। ভাগ্যিস  ,পাড়াতুতো ওসি কাকুর সাথে অসীমার বাবার গ্রামের বাড়িতে দেখা হয়ে যায়। তখন সব খুলে বলেন অসীমার বাবা। আবার কেস পুনরায় আদালত অব্দি গড়ায়। কাজের মাসি রাজসাক্ষী হয়। সব খুলে বলে। জীবনবীমার টাকা হাতাতে অকালে অসীমাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
কাজের মাসিকে টাকার প্রলোভন দিয়ে কাজ হাসিলের চেষ্টা করে ওরা। এও জানা যায়  অসীমার স্বামী কে প্রায় মানসিক রুগী তে পরিণত করা হয়। এই ভেবে চাকরিটা যাতে ছোট ভাই পায়।
 কিন্তু অসীমার মৃত্যুর এক বছর পরে  অসীমার স্বামীর  মৃত্যু হয় হার্ট এর অসুখে।

আদালতের রায়ে , শাশুড়ি ,ননদ আর দেওরের সাজা ঘোষণা হয়। স্বামী ওই দিন অনুপস্থিত থাকায় বে কসুর খালাস পায় ।
জেল খাটার সময় শাশুড়ির মৃত্যু হয়। সাত বছর পর ননদ আর দেওরের মুক্তি হয়।
 কী পোড়া দেশ অসীমার ? দেওর আর ননদের বিয়েও হয়। গরীব বাড়ির দুটি ভালো ছেলে ,মেয়ের সাথে। একটি সন্তান রেখে দেওরের অজানা অসুখে মৃত্যু। ননদ এর খবর এখন অজানা। মানে খুশী জানে না। কাকিমা আর ভাইয়ের সাথে খুশীর যোগাযোগ আছে।

অসীমা  অকালে  চলে যেতে ,ছোট্ট খুশী তখন দাদুদিদার কাছে। ও  বড় হচ্ছে। কলেজের পরে একটি সুন্দর মানুষ এর সাথে বিয়ে হয়। ও খুব সুখী।দুটি ফুটফুটে যমজ ছেলেমেয়ে ওঁর। খুশী মনে করে এঁরা ই খুশীর ,বাবা আর মা হয়ে এসেছে।
মা ,বাবার কাছে খুশীর খবর পেয়েছে অসীমা।
 এখন অসীমা সেই ছোট্ট মেয়ে।  খুশীর খুশীতে খুশী  বাবা ,মা আর অসীমা। ..........

সমাপ্ত







,




















Saturday 7 July 2018

অতিক্রম 
#মৌসুমী রায় 
আজ বাড়িতে ষষ্ঠী পুজো। যমজ কন্যারা ছয়দিনে পা দিয়েছে।   বাড়ির বড় আদরের মুসু আর রূপু ।জন্মের পরপর দিম্মি  ও ঠাম্মির নামে ডাকা হতো ওঁদের। নামকরণ হয়নি। ডাক নাম ওই ই ওদের। আর বদল হয়নি।  ভালো নাম   মুস কান  সেন গুপ্ত আর রূপটান সেনগুপ্ত। 
গম রঙের সাথে পানপাতা মুখ ,পটলচেরা চোখ ,একমাথা ঘন কালো চুল পিঠের ওপর ছড়ান ,বেদানার  মত সাজানো দাঁতের হাসি ঝরে পড়ে মুসুর । আর গ্রীবাটিও রাজহংসীর মতো। নৃত্যে পটিয়সী হওয়ায় গ্রীবাটি যেন অতীব সুন্দর। 
রূপু গান জানে ,আবৃত্তিও জানে,সাথে  ওদের মা ও  । গানে রবিঠাকুর আর নৃত্যে কত্থক। দুটিতেই যখন তাল দেয়  রূপু আর মুসু ,সেটাও দেখার মতো। 
বিশ্বকর্মা যেন কতো সময় নিয়ে ওদের গড়েছে। 
আজকাল পথে ঘটে বড্ড নজরে রাখতে হয়। মেয়েদের  মা, এই দায়িত্বে। ঠাম্মি  আর দিম্মি সংসারের সমস্ত কিছুই সামলায়। বলেন আগে আমার নাতনিরা  পরে সব কিছু। বোধকরি বাড়িটি ও  সদস্যদের বিশ্বকর্মা দেহে মনে একই সুতোয় বেঁধেছে। তবে মুসু  আর রূপুদের  বুঝতে দেওয়া হয়না যে তোমরাই  সব। কারণ  শৈশব যাতে অহংবোধে হারিয়ে না যায়।  তোমরা আর পাঁচটা বাচ্চা দের মতো বড় হও। মুসু  রূপু এতো মিষ্টি যে বলার অপেক্ষা রাখেনা। পাড়ার দাদারাও মুসুদের  খুব স্নেহ করে।
--একবার  হল কী  ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "পথিক "কবিতা অবলম্বনে পাক্কা আধঘন্টার এক পলকহীন অনুষ্ঠানের আয়োজন। তাঁর মধ্যমণি কেও ছিলোনা ,কিন্তু অপূর্ব এক অভিনবত্ব এনেদিয়ে ছিলো। বলা বাহূল্য রবি ঠাকুর একাই সব। তবুও যথাযথ পরিবেশনের দায়িত্বও কম নয়।পাড়ার দাদাদের স্নেহের ও শাসনের সুবাদে।মুসকান ,ওর মা এবং মুসু আর রূপটান এর পরিবেশনা। রূপটান ও খুব মিষ্টি। শ্যামলা বরণে আরও মাধুরী।পঁচিশে বৈশাখ ,সকাল সকাল উঠে বেশ উৎসবের মেজাজে দুই বোন। অন্যদিন দেরীতে ওঠে ,তাও আবার ওঠরে ,ওঠরের ফল। ওদের কলেজ থাকে যখন তখন সেটা বলতে হয়না । দুইজনেই নৃত্য এবং সঙ্গীত নিয়ে পড়ছে।
 সকলেই বেশ আগ্রহী। মায়ের পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু অনুষ্ঠান। "পথিক ওগো পথিক ,যাবে তুমি এখন এ যে গভীর ঘোর নিশা ---বিদায়পথে দিয়েছি বটে বাধা "গলার ওঠানামার করুণ আবহে রূপটানের মিষ্টি গলায় "মোরে বারে বারে ফিরালে ,মোরে --"সুরের মূর্ছনায় দর্শক আপ্লুত। আবার শুরু "পথিক "কবিতার পাঠ। "পথিক ওগো মোদের নাহি বল ---রয়েছে শুধু আকুল আঁখিজল " কত্থকের শৈলীতে "কাঁদালে তুমি মোরে "গানের সাথে মুসকানের নৃত্য পরিবেশন এক অন্যমাত্রা এনেছিল। আবার শুরু "তিমির রাতি --হৃদয়ে তব আসিল অবতরি "রূপটানের গলায় "আজি এ নিরালা কুঞ্জে আমার অঙ্গ মাঝে "ঝোরে পরছে "লতায় লতায় "শব্দের অর্থে। পরিবেশ স্তব্ধ ,সেখানে একজনের অস্তিত্ব তিনি স্বয়ং রবি ঠাকুর।
আবার শুরু পথ চলা পথিকের। "পথ পাগোল পথিক ,রাখো কথা ,নিশীথে তব কেন এ অধীরতা।"রূপটানের গানে মুসকানের নৃত্য "হায় অতিথি ,এখনি কি হোল তোমার যাবার বেলা --
---আমোদ আহ্লাদ উছলে পড়ে বোধকরি পরিবারটি । আড়ালে মুসু আর রূপুর কথপোকথন শোনে ওদের মা। কত কথা তার শেষ নেই।আজ ওদের বিষয় পাহাড়। সান্দাকফু ভ্রমণ ওদের মনে আনন্দ দিয়েছিলো। মানেভঞ্জন থেকে হাঁটার কথা ছিল ,পরে গাড়িতেই যাওয়া হয়েছিল।পৌঁছনোর চার কিলোমিটার আগে গাড়ি বিকল। এবার হাঁটতে হবে। বেশ আনন্দ হচ্ছিলো প্রথমে। রাস্তা এতো খাড়া যে অংকের জ্যামিতির কথা মনে পড়ছিল। কখন পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ তো কখনো ষাট ডিগ্রি। বুকের ভিতর পাথরের বোঝা নিয়ে পাহাড়ে ওঠা। সে এক প্রাণবায়ূ বেরোনোর উপক্রম।  চলতে চলতে কাজু ,কিশমিশ দুচারটে মুখে চিবোতে চিবোতে একঢোক একঢোক জল পান। এই মুসু ,রূপুর ডাকে পাহাড়ের গায়ে লেগে প্রতিধ্বনি এক অনুরণন সৃষ্টির দুনিয়ায় পৌঁছে যাচ্ছিল। রুক্ষ পাহাড় এর  গায়ে গাছ গাছালির পোশাক পড়েছে। পাহাড়ী ফুলে ফুলে অলংকারের সম্ভার সাজিয়ে রেখেছে। রঙিন ফুল দুই বোন চুলে গুঁজে নিচ্ছে ,মায়ের খোঁপায় গুঁজে দিচ্ছে। দুই বোনে ভূপালী সুরে তান বাঁধছে। এই সব চলছে চলার পথে যখন একটু জিরিয়ে নিচ্ছে ওরা। মা ওঁদের গল্প শুনছে আর ঝালিয়ে নিচ্ছে নিজের আনন্দটাও।বাবা তো বোমভোলা। মেয়েরা প্রাণ ভোমড়া। ঠাম্মি , দিম্মী মানে ভঞ্জনে আছেন নেপালী মহিলা পরিচালিত হোটেল এ। নেপালী মেয়েদেরও ঠাম্মি ,দিম্মি।
---পাহাড়, পুরুষ এবং  মূর্তিমান হলে কি হবে তার স্নেহ ভালোবাসার সম্পূর্ণতা যেন বাবার মত। কোথাও প্রশ্রয় তো কোথাও নিষেধ। যেমন ধর পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ কর এটা প্রশ্রয় আর খাদের কিনারে যেতে বারণ এটা নিষেধ। পাহাড়ের অলিখিত নিয়ম। এক পুরুষের কত ভাগ ,যেমন কখনো সে সন্তান ,কখনো ভ্রাতা আবার কখন সাথী বা বন্ধু ,আবার জীবনে চলার পথের সঙ্গী এবং পিতা।
মুসু আর রূপুর উপলব্ধি একই। পথে চলতে চলতে পুরুষের বিশ্লেষণ ওদের মা কে জানান দিলো ওরা সাবালিকা। আর চিন্তা নেই ঠিক পথেই ওরা এগোচ্ছে। পৌঁছে যখন ওরা বিশ্রাম নিচ্ছে তখন সন্ধ্যে নেমেছে। আকাশ ভরে জ্যোৎস্না আর কিরণ লেগেছে পাহাড়ের কোণে কোণে। যেন লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ। গানে গানে ভোরে উঠল মোহময়ী রাত।
ফেরার পথে গাড়ি পাওয়া তে সবাই খুশী। রাস্তায় পাহাড়িমেয়ে ,বাচ্চাদের দল সে এক বসন্ত সমাগম। ওদের হাতে চকলেট ,কাজু ,কিশমিশ দিচ্ছে মুসু ,রূপু। চা খেতে নামার ফাঁকে একটু এদিক দেখা ,মানুষের সাথে কথাবলা। খুব মিষ্টি ওরা। সরলতায় স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে গোলাপী গালের চ্যাপ্টা নাক এর ঝলমলে চোখের মুখ গুলো। মেঘমা ,টুমলিং ,গৌরীবাস জায়গার নাম গুলো মানুষ গুলোর মত সুন্দর। পাহাড়ের একলা পথে যেতে যেতে পাহাড়ী ছেলেদের সহযোগিতা মুগ্ধকর। হাসি মুখের অধিকারী সম্প্রদায় পাহাড়ি মানুষরা।
রূপু ,মুসুদের পাহাড় কে পুরুষ কল্পনা করে নানান পর্যায় ভুক্ত করেছে। পুরুষ না থাকলে নারী র সৌন্দর্য অপূর্ণ।
----নদীর গতি ধারাকে নারীরূপে কল্পনা। একেকদিন ছুটি পেলেই দুই বোনের কল্পনা বন্যা বইয়ে দেয়। ওদের দুই পুরুষ বন্ধু আছে রুনু  আর ঝুনু । ওরাও ছুটির দিনে যোগদেয় আদর খায় ওরাও  আদর করে।মুসু আর  রূপু দের । জ্বর জ্বালা সবই যমজের যমজ। বোধকরি চিন্তা ধারাও একই। দুজনেই মেধাবী। একজন নাচে আর একজন গায়। এভাবেই ওদের আলাদা করা যায় নচেৎ নয়। ও হ্যাঁ আজকের ছুটির দিনে ওদের বিষয় নদী। ওঁরা যখন আলোচনা করে তখন নিশ্চুপ শ্রোতা রুনু আর ঝুনু । কোনো উৎপাত নেই ওদের। বরং আলোচনা র থেকে অন্য কিছু ঘটলে মারাত্বক। রুনু  আর ঝুনু তখন নিজেদের মতো কোরে কলহ জুড়ে দেয়। তখন বোনেরা মূল আলোচনায় ফিরতে বাধ্য হয়। হ্যাঁ ওই যে বলছিলাম আজকের খবর নদী। নদী ওঁদের চোখে কেমন মেয়ে ,মা ,বধু। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরে ওরা গোমুখ বেড়াতে গিয়েছিল বাবা মায়ের সাথে। পথে র সাথী নদী। চিরবাসা নামে একজায়গায় খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটতে লাগলো। ভুজবাসা তে রাত্রি বাস। জ্যোৎসনা ভেসে গিয়ে পাহাড় কে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। পরের দিন গোমুখের উদ্যেশ্যে রওনা। কুলকুল বয়ে চলছে আপন বেগে আপনহারা মাতোয়ারা স্বচ্ছতোয়া । নদীর  বয়ে যাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি রূপে ধরাদিয়েছে। এখানে ই নদী নারী। যে না থাকলে সৃষ্টি থেমে থাকত। কিছুদূরে দেখাগেলো জলের উপর বরফের টুকরো ভেসে ভেসে চলেছে। এর মধ্যে খুঁজলো নারীর ধারণ ক্ষমতা। গর্ভে যেমন ভাবে সন্তান কে বয়ে নিয়ে চলে তাঁর মা ,ঠিক যেন তেমনই ,কোনো ভার লাগেনা মায়ের মতো। চলতে চলতে নদীর উৎস স্থল গোমুখের সম্মুখে। এ যে নারীর সম্পূর্ণ রূপ। কন্যা -বধু -মাতা। সর্বং সহা। পাথরে ধাক্কা খেয়ে এঁকে বেঁকে নদী প্রতি বন্ধকতা কে ভেঙে নিজের গন্তব্যে পৌঁছচ্ছে। এই হল নারী শক্তি। যতই বাধা বিপত্তি আসুক নারী পৃথিবীর নাড়ির স্পন্দন।
---------আজ মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। রুনু আর ঝুনু  আজ দুষ্টুমী একটু বেশী মাত্রায় করছে। ওদের শান্ত করার একটাই ওষুধ।  ওষুধ  গান।বাইরে বৃষ্টি ঘরে রুপু গাইছে "এমন দিনে তারে বলা যায় "কি সুরেলা কণ্ঠ। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। পরপর গেয়ে চলেছে,"নিবিড় মেঘের ছায়ায় মন দিয়েছি মেলে "ওগোপ্রবাসিনী "যখন গাইছে মনে হয় যেন সে কোন সুদূরে বসে শুনছে এপারের কথা। আহা। ওঁরাও আজ স্তব্ধ। বোনে বোনে আজ কথায় গানে রবিঠাকুর এর গানে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়,সুবিনয় রায় ,আশীষ ভট্টাচার্য থেকে ঋতু গুহ।  বেগম আখতার থেকে গুরুদাস মান ,দলজিৎ ,অরিজিৎ সিং।এর মাঝে রুনু ,ঝুনুর প্রিয় গান বাজানো এবং ওদের swag নাচ হল। digy bom bom .এই ওষুধ পড়েছে ব্যস আর চিন্তা নেই। মুসুদের কথায় আর বিরক্ত করবে না ওরা।
রবীন্দ্রনাথের গানে এই প্রাতঃস্মরণীয় দের চিন্তা ধারায় রূপু অনুসরণ করে। অনুকরণ করেনা। বেগম আখতারের "মেরে চেহেরে সে গম "গানটি প্রায় গাইতে চেষ্টা করে। চেষ্টা করে ঊর্দু উচ্চারণটা সঠিক করতে। আর দলজিৎ থেকে অরিজিৎ গান চালিয়ে মুসুর কথ্থক নৃত্য। সে যেন দেখেও আর শুনেও শান্তি। ওরা সবাই খুব আনন্দে থাকে। সব খুশির মাঝে দুঃখ এলেও ভেঙে পড়েনা পরিবারটি। মুসু ,রূপু  এখন শিক্ষক। একজন নৃত্যের এবং একজন সংগীতের।
----আজকে ওঁদের রবিঠাকুরের নারী শক্তির বিন্যাস চলছে। রুনুঝুনু সামনের পা দুটি টানটান করে মেলে দিয়েছে। এ যে গভীর বাণী তাই উঁচু হয়ে আছে তাদের শ্রবণ যন্ত্র দুখানি।বিষাদ ,আনন্দ ,অবকাশ এমনকি অবসাদে যাঁর শব্দের ভীড় নৈঃশব্দে কথার সমৃদ্ধি ঘটায়। অপ্রকাশ মেঘে  কখন যে স্বপ্রকাশ র রোদ্দুর আনে বোঝা কঠিন। মেঘের বিকেলে মন কেমনের রসদ। রাতের স্বপন গুলো যখন মোহে অজানায় মিলিয়ে যেতে চায় তখন তাঁর শক্তি ঠাওর হয়। রুনু ঝুনু দুই দিদির ভাষায় সড়গড়। আজ ওরা চুপটি কোরে লক্ষীটি।
পাহাড় ,নদীর মিলন এর সৃষ্টি ঝর্ণা। সে চঞ্চল কিন্তু মধুর। পাহাড়ের অহং নদীর শান্ত রূপে আর কলধ্বনিতে মজে যায়। প্রকৃতির দৈনন্দিন ওঠাপড়া যেমন সহজে নজর আসেনা কিন্তু সমস্ত টাই তাঁর দেওয়া। তেমনি নারী শক্তির দর্শন রবি ঠাকুরের সৃষ্টি যা জীবনের ওঠাপড়ায় সমৃদ্ধ ঘটায়। বাসব দত্তা প্রতিকারে ব্যস্ত ,পুরী দর্শনের পরে রানীর অসহনীয় এবং প্রমোদ প্রিয় যেমন ঠিক তেমনই তাঁর সহচরীর নিষেধ এক অন্য মাত্রা আনে। চিত্রাঙ্গদা নারী জাতির পুরুষ ও নারীর মেলবন্ধন যা প্রত্যেক নারীর নাড়িতে। প্রকৃতি সে নিজেই সংস্কারক। কুন্তীর মাতৃত্বের স্বীকারক্তি। রক্তকরবীর নন্দিনী।  সবই মেয়েদের শক্তি যেখানে লুকানো কিছুনেই। ঘরে ছয় টি নারী একটি পুরুষ মুসুদের। সেই বাবাকেও তাঁরা তাঁদের সম্মান দেয় এবং বাবাও ওঁদের মান দেন্।রুনুঝুনু ও সদস্য ।নিমন্ত্রণ বাড়িথেকে ওদের খাবারের বাক্স আসে।
বাইরে আষাঢ়ের পূর্ণিমা, জানালা দিয়ে জ্যোৎস্না ভেসে আসছে একজন গাইছে, "ও আষাঢ়ের পূর্ণিমা" আমার আর অন্য জন নৃত্যের আবেশে, আর ওনারা জুলজুল করে চেয়ে আছে। দিম্মি ঠাম্মি ওদের সমালোচক।  মায়ের ভাবনা মেয়েরা তো বড় হচ্ছে। স্বাবলম্বীর পরে পাত্রস্থ করতে হবে। আর বাবা ভাবছেন এমনি করে যায় যদি দিন যাক না। মেয়েদের ,বাবা ঘরের আড়াল করতে চাই না। বন্ধুদের মেয়েদের পাত্রস্থের  পূর্বের  ও  পরের অবস্থান এ কয়েকটি পরিবার তাঁর কেমন যেন ঠেকে।
--------আজকে সন্ধ্যেটা বড্ড আনচান করছে তাঁর। একবার ঘর একবার বাহির করছে। পায়ে পায়ে লটা পটি  করছে রুনুঝুনু। তবুও সন্ধ্যে বাতি দিয়েছে। রাত ক্রমশঃ বাড়ছে। ওঁদের বাবাও ফেরেনি এখন ও। আর দুই বোন ও ফেরেনি আর ফেরার সময় ও হয়নি। বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছে। আজ রান্না করতে বারণ করেছে মেয়েরা আসার পথে খাবার নিয়ে আসবে।আজকের রাতে জোছনার আড়ি। গাঢ় আঁধারে দিক শূন্য। মায়ের ভাবনায় আত্ম বিশ্বাসের সুগন্ধী ভরপুর।  দিম্মি ঠাম্মিও দৃঢ় মানসিকতার।  মনোস্কামনা মিষ্টতায় আচ্ছন্ন। স্বভাবে সততা ,প্রায় অর্ধেক জীবন গোলাপের মধুরতায় ভরা। সবই তাঁর দুই কন্যা ঘিরে। ওরাই পৃথিবীর দুই গোলার্ধ। অনেক ঘাটতি জীবনের মুশকিল আসান ওই মেয়েরা। জীবনের অর্থ বহ সময় চলে গিয়েছে অনেকে বলে এটা করতে পারতে ,ওটা করতে পারতে। কিছুতেই কান দেয়নি ,তাঁর ভাবনা ছিল জীবনটা আমার ,কেমন চালাব সেটা নিতান্ত নিজের। হাওয়া কখনো এক দিকে বয় না। এখন যেদিকে বইছে সেইদিকেই বইব এই চিন্তা ধারার ওদের মায়ের। এখন শুধুই এঁরা। উদাস হাওয়ায় মন কে পাখি ভেবে কত ভাবনা আষ্টেপৃষ্টে এই মুহূর্তে। সারাজীবনের পাওয়া না পাওয়া সব কিছুই ইচ্ছে র আকাঙ্খা। সেখানে কোনো দুঃখ এবং কম বা বেশী পাওয়ার নয়। কাঁটার আঘাতে ফুল কোনো কলঙ্কর ভাগীদের হয়না। কিন্তু ফুল যখন চুপচাপ আহত করে তখন ই সইতে পারা দুঃসহ। কত কী ভাবনারা কি হাওয়ায় মাতাল আজ অন্য সমীরণে। নিকষ আঁধারে একলা পথিক চলতে চলতে ওই পথ হারালো বুঝি। শুনিস নি  কি শুনিস  নি তার পায়ের ধ্বনি  গানটা হঠাৎ গলায় সুর পেলো। অনেকদিন পরে নিজের জন্য সময় এলো কাছে। গান শেষের ক্ষণেই দরজায় টিংটং।বিধ্বস্ত  দুই মেয়ে। খানিক বাদে ই ওদের বাবা। রুনুঝুনুর চঞ্চলতা খুব বেড়ে গিয়েছে।ঠাম্মিরা খুশী ওরা অক্ষত।
-----মুসু আর রূপুকে খুব তৃপ্ত লাগছে এখন। অনুষ্ঠানের পর ওরা রাত  আটটা  র মধ্যেই ফিরছিলো। একেতো অন্ধকার তার মধ্যে টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি পড়ছে। রিকশা নিয়েছিলো। মা বলেছিল তাড়াতাড়ি ফিরতে। সেই সকাল থেকে কুর্চির বাড়িতে। খুব আনন্দ করেছে। কুর্চিদের বাড়িথেকে আসতে একটা মাঠ পেরোতে হয়। ওখানে এখন সমাজ বিরোধীরা ভীড় জমায়। মুসুদের যাওয়া আশা করতে দেখে প্রায়। কিছু বলেনা ওরা । রিকশাতে ফিরতে ফিরতে দুই জনে ভয় কাটানোর জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কেও কথা রাখেনি জোরে জোরে আবৃত্তি কোরে চলেছে। রিকশা কাকুও চেনা। কাকুও বেশ গতিতে চালাচ্ছে। কবিতা শেষ হতেই মাঠ পেরোনোর মুখে গোঙানির শব্দ। কেও কাওকে ছেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে শব্দ আসছে। দুই কন্যা বরাবরের ডাকাবুকো। বলে ,কাকু রিকশা থামাও। সেতো শুনবেনা ,বলে তোমার মা বলেছে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছেদিতে তোমাদের। ওরা নাছোড় বান্দা। এক লাফে নেমে শব্দের হাওয়ায় এগিয়ে চলেছে। পিছনে রিকশাতে তালা দিয়ে কাকুও। দেখে দুই টি ছেলে মেয়েটিকে মুখে ওড়না গুঁজে দিয়ে হাতে পিছমোড়া করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এরাও উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ক্যারাটে র ফাঁদে কাত কোরে ফেলেছে। দুই বোনে দুই জনকে উত্তম মধ্যম। আর রিকশাকাকু মেয়েটিকে বাঁধন মুক্ত করছে।
দুই বোনের ক্যারাটে শেখা আছে। ওরা সব সবুজ ,কালো বেল্ট ও পেয়েছে এই প্রশিক্ষণে। তার মধ্যে দুই বোন কেশবতী কন্যে। ওরা চুলের বন্ধনীতে সবসময় ধারালো বক ক্লিপ রাখে। চাণক্যর ন্যায় দণ্ডের মতো ওরা বয়ে চলেছে ক্লিপ।
প্রথমে কুপোকাত কোরে ,শরীরের নানান জায়গায় বক ক্লিপের চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। শয়তানরা  যন্ত্রনার  পাথারে কুল খুঁজে পাচ্ছে না। মেয়েটিকে নারকীয় অত্যাচার থেকে বাঁচিয়ে ,একটা মানুষের মত কাজ করেছে।
মেয়েটি জানায় যে বাড়িতে ওর ছোট মেয়ে আছে ,মা আছে আর নেশা খোর স্বামী আছে। সেই ভোর বেলা রান্না করে ,ওদের খাবার গুছিয়ে ,মেয়ের স্কুল এর সব গুছিয়ে এখানে হাসপাতালে আয়ার কাজে আসে। আজ কে ডিউটি বদলাতে দেরী হয়েছে। দুটো পয়সা বাঁচানোর জন্য আজ প্রায় ছুটতে ছুটতে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছিল। নইলে এই বাস চলে গেলে ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা হয়ে যাবে। স্বামী সন্দেহ করবে ,নেশা করবে ,পেটাবে। মেয়ের সামনে গালাগাল পারবে।
-------মুসুদের সঙ্গে মেয়েটি এসেছে। ওর আজ বাড়ি ফেরা হয়নি লাস্ট বাস চলে গিয়েছে। ওর সম্মান রক্ষা হয়েছে আজ। স্বামী যতই মারধর করুক ,গালমন্দ পারুক। মেয়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে ,কিন্তু ওর দিদা সব সামলে নেবে। দিদা এবং নাতনী মালতীর সহায়। মেয়েটির নাম মালতী।
আকাশ যেমন ছিল তেমনই আছে ,শুধু মনের আকাশে আঁধার। অংক ,ফলাফলে কবিতার মত ছন্দে ঝোরে পরে মিলনের সাথে ,জীবনের যোগ বিয়োগে দেহ মনে উথাল পাথাল। সূর্যের আলো কোথাও কম পড়েনি ,মনের আলোকপাত এ আজ খানিক কম পড়েছে।জ্যোৎসনা মাখানো মায়াবী রাতে সুরের বন্যা ভাসানো ভেলায় আজকের যাত্রীর হৃদয় অমাবস্যার ঘরকন্যা। ব্রহ্মান্ড জুড়ে নক্ষত্রের পসারী ,কিনবে যে মন সেই মন আজ কে শুধুই ভিখারী। মালতীর মনে আজ কী ঘটে চলেছে তার টের পাওয়া যাচ্ছে অসহায় চোখের চাহনি তে। মুসুদের বাড়িতেও চলছে মনের দুর্যোগ।
আজকে মুসু ,রূপুদের বাড়িতে আকাশের যেমন করে গাওয়ার কথা তেমন ভাবেই গাওয়ার কথা ছিল ,কিন্তু আজ বেসুরো পরিবেশ। ওঁরা কোথাও থেকে ফিরে কত গল্প জুড়ত আর শ্রোতা ঠাম্মি ,দিম্মি , বাবা ,মা ,রুনু ঝুনু। বিশেষ আকর্ষণ রুনুঝুনুর টানটান পা মেলে জুলজুল চোখে চাওয়া আর মাঝে মাঝে একটা মিষ্টি আওয়াজ। আজ কিছুই নেই। আজকের শুধুই মালতী। মালতী বলে ওর প্রিয় কবি  জয় গোস্বামী। প্রিয় কবিতা বেণীমাধব তোমার বাড়ি যাব। আরও বলে কবির র মালতী সেলাইয়ের দিদি মণি আর এই মালতি হাসপাতালের আয়া রাণী। রাণী কথাটা বুঝেই বলেছি দিদি ,কোন কাজকে ছোট ভাবিনা ;এর বিনিময়ে আমার সংসার চলে। বলতে বলতে হঠাৎ বলে --অভাবে আমিও "যদি নষ্ট মেয়ে হই "...
জানো আমিও তোমাদের মতই বড় হচ্ছিলাম। বাবা ,মা খুব স্বপ্ন দেখত আমাকেও দেখাত ,একদিন বড় হব ,নিজের পায়ে দাঁড়াব। কিন্তু মন যে বাতাসের থেকেও চঞ্চল। সেই দিন ,যেদিন আমি এই ছেলেটার কথায় এক কাপড়ে বেড়িয়ে এলাম।  একই কলেজে দুজনেই পড়তাম। আমার কবি জয় আর ওর শক্তি চট্টোপাধ্যায়। আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলত ,"মালতী বাড়ি আছো "? কী মোহ যে সেই থেকে ঢেকে ছিল ,সেই কুয়াশার জাল কেটে আজও বেড়োতে পারিনি। শুরুর দিনগুলোতে আকাশে মেঘেরা গাভীর মত চড়ে বেড়াত ,আজকে সেই মেঘেদের দেখা পায় না দুজনেই। কত কথা ছিল দুজনের রাখার ,ও কথা রাখেনি।  মেঘ জমলে দুজনেই গাইতাম "আজ যেমন করে গাইছে আকাশ "--এখন মনে সবসময় ঘন নিকষ আঁধার। সকল  মুখর ভাষার নীরব যন্ত্রণার ছটফটানি আজ  ঝড়ের তান্ডবে তছনছ সংসারে।
বিচ্ছেদ ,বেদনা দেহ থেকে মনে ওই ধরিত্রীর সুতোতে বাঁধা পড়েছে। ধরিত্রী আমাদের মেয়ে। এই মালতী আর শক্তির একমাত্র আকর্ষণ। শক্তি নেশাড়ু কিন্তু ধরিত্রীর কাছে একান্ত ই বাবা। নেশা কাটলে বাবার আর মেয়ের স্নেহ সুরের আর বাণীর  অদৃশ্য সুতোয় মেল্ বন্ধনে  দিগন্ত বিলীন। ধরিত্রী জানে শক্তির নেশা ,কিন্তু বাবা যখন কবিতা বলে তখন যেন মন্ত্রমুগ্ধ। এক নাগাড়ে বলে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল মালতী। কথার পাকে রাত গড়িয়ে সকাল। আজ মালতী হাসপাতাল যাবে না। আজ বাড়ী যাবে সোজা।
-------চিন্তা তে রাত্রে কেও দুচোখের পাতা এক করেনি। বাড়ী পৌঁছতেই সকলের আনন্দ। সাথে আরও দুই কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। শক্তি আজ সংযত ,কাল রাতে নেশা কাটার পরে অনুভব করেছে একা এবং একান্তের অর্থ। তাঁর অনুভবে "আমরা সকলেই যাত্রী ,ভ্রমণের চাবিকাঠি একজনের হাতে। কোথায় থামতে হবে আর গন্তব্য কোথায় সেই জানে। একলা সাথী হলে সমাজে র বড় শাস্তি ,একান্ত আশীর্বাদ এবং শান্তি আরামের। একলা ,ছটফট করায় কিন্তু একান্ত শুধুই অনুভবের। মন এ আজ  মূল্যবোধ। পুলিশ ছাই এর দড়ি পাকাতেও পারে। কিন্তু সেই ছাইয়ের দড়ি পাকাতে গুটিকয়েক মানুষজন ও ওস্তাদ। নির্যাতিতা বাড়ি ফেরায়    উৎসাহীর আনাগোনা  বেড়েছে। আজকে শক্তি সেই আগের মতই ,বলে 'মালতী বাড়ী এসেছ ,তুমি কি আগের মতই আছ নাকি খানিক বদলেছো"। যা আছো আছো ,তুমি আমার ই আছো।
আজকের খবরের কাগজে দুই দুষ্কৃতির অপ কম্ম এবং পুলিশ হেফাজতের খবর বেরিয়েছে। নির্যাতিতার নাম পরিবর্তিত এই লেখা আছে। রূপু মুসু দের বাড়ি থেকে কথা বলেছিল মালতী বাড়িতে ।শক্তি ও মালতী বিশ্বাস করত বীজ ভালো হলে গাছ ভালো হবে। মাটির ওপর নির্ভর করে জলের স্বাদ মিষ্টি না নোনতা হবে।বীজ আর মাটির যত্নে আজ ধরিত্রী।
গাছটিতে ভালো জল ,সার দিতে হবে। ভবিষ্যতের সুন্দর ফুল ,ফলের আশায়। ধরিত্রীর স্কুলে  ভূগোল শিক্ষিকা র হিমালয়ের বর্ণনা শুনতে শুনতে ধারণা তৈরী করেছিলেন ওঁর মনে। হিমালয়ের বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় এখনও অনেক চলতে হবে। ওই বিশালাকার এর সামনে আমি অতি ক্ষুদ্র। ওঁর বাবার নেশার সময় অগোছালো কথা মনকে পীড়া দিত। পীড়া দিত বসবাসের পরিবেশকে। পড়াশোনায় ভালো ,বিদ্যালয়ে আবৃত্তি ,গানে তার প্রশংসা। বাড়িতে বন্ধুরা আসতে চাইলেও ও আনেনা। বন্ধুরা যখন ওদের বাড়ির  ,গাড়ির কথা বলে তখন ও শোনে। আনমনা হয়ে যায় ,ওরা বলে তোর বাড়ির কথা বল?ধরিত্রী ওর মায়ের কাছে শুনেছিলো এক হত দরিদ্র মহিলা ,যার বাড়ির চাল ফুটো ;বৃষ্টি হলে জল পড়ে ঘরে। আবার জ্যোৎস্না হলে ওই ফুটো চাল দিয়ে ঘর আলো করে। জ্যোৎসনার  কথাটা মনে বড় ধরেছিল সেদিন। আজ বন্ধুদের ধরিত্রী বলে "আমার বাড়িতে জ্যোৎসনার আলো আসে প্রতি মাসে ,তোদের বাড়ি তে জ্যোৎসনা আসে ?"---
ধরিত্রীরা এ খানে থাকবে না। ওদের গন্তব্য মুসুদের বাড়ী। সেখানে একখানা ঘর বাথরুম আছে কোন ভাড়া লাগবে না। ওদের আবাসনের দেখ ভালের ভার এখন মালতীদের।
এখন মালতী রা খুব ভালো আছে। মালতী ওর নিজস্ব আয়া কেন্দ্র খুলেছে তার প্রশিক্ষণ দেয়। পাশেই একটা ঘর ভাড়া নিয়েছে। সেখানে শক্তি কবিতা শেখায়। ধরিত্রী এখন গান ,কবিতা,নাচ শেখে।  পুরোনো সেই বাবাকে ধরিত্রী খুঁজে পায়। একবার ছোটতে  ধরিত্রীর বার্ষিক পরীক্ষার ফল খারাপ হয়েছিল। বাড়ি এসে খুব কেঁদে ছিল। বাবা তখন নিজেই ধরিত্রীর একটা ভালো খারাপের রেজাল্ট তৈরী করে ছিল। সেখানে ধরিত্রী মানুষ হিসেবে কেমন ?  প্রত্যেকটাতেই  অসাধারণ। এভাবেই চলত। অভাবে বাবার বিপথ অবলম্বন। এখন বাবা আগের মতন।পাড়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। মুসুদের সাথে অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে। ধরিত্রীর বাবা মা ও অংশ নেয়।ওরা এখন বসুন্ধরা আবাসনের। 
ওদের বীজ এবং মাটি দুটোই উর্বর ছিল। তার ফল ধরিত্রী।  মুসুরূপুদের বাড়ির দেখভালে ধরিত্রী আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। যে মানুষরা একদিন অবহেলা করে ছিল তারাও এখন আই পি এস ধরিত্রী রায় এর আত্মীয় নামে পরিচয় দেয়। ধরিত্রী চেয়েছিল ব্যতিক্রমী হতে। সেটা পেড়েছে।  চাকার ওপর নীচের ধারাবাহিকতা এবং ভাগ্য ,দুইয়ের সংমিশ্রণের সক্ষমতা ই    ব্যতিক্রমের পথে অতিক্রম। ............





















Wednesday 18 April 2018

আমার প্রিয় অরুণিমা দিদি বাংলা শব্দ ও অর্থ খেলায় আমায় ডাক দিয়েছে কোন সকালে। 
সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠেই সাড়া দিচ্ছি দিদি। 
১) করন্ডিকা -খালুই ,চুপড়ি।
২)দর্ভ -কুশ ,কাশ । ৩) চত্বা রিংশি ,চত্বারিংশত্তমী -৪৭ সংখ্যা ,সংখ্যক ,সাত চল্লিশ। 
৪)মাতগুর -ঝোলা গুড়। 
৫)পঞ্জু ড়ি -দুই জুড়ি ও পোয়া (পাশা খেলার দান )
৬)লখলাইন -মাঞ্জা দেওয়া রেশমী সূতো। 
৭)সংশয়াপনোদন -সংশয় দূরী করণ ,দূরী ভবন। 
৮)শুক চষা -সেবা করা ,যত্ন করা। 
৯)রোবাইয়াৎ -চতুষ্পদী কবিতা। 
১০)হুলকে ,চড়কা পারা ,জলুই এবং পক্কাশয় জাত বাত -উঁকি দেওয়া ,ধবধবে সাদা ,পেরেক এবং বাত কম্ম। 
           আমি মৌসুমী ডাক দিলাম তোমাদের এই খেলায় যোগ দিতে---
১)অনিন্দিতা ভট্টাচার্য্য। 
২)সুস্মিতা চক্রবর্তী। 
৩)শান্তনু চ্যাটার্জি।
৪)ঝর্ণা চক্রবর্তী।  
৫)বীণা বোস । 

Tuesday 13 March 2018

অর্ধেক আকাশ 
#মৌসুমী রায় 
ওই দূরে দাঁড়িয়ে বিশালাকার অর্জুন। তাঁর চারপাশে পরিবেষ্টিত হয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া ,রাধাচূড়া ,অশোক ,পলাশ আর পারুল এবং খানিক তফাতে শিমুল। কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচুড়া পাশাপাশি থাকায় মৃদু কন্ঠে বাক্যালাপ চলছে। ভালো ,মন্দ সব মিলিয়ে জুলিয়ে। হঠাৎ ছন্দপতন ,রাধাচূড়া বোলে ওঠে "সমুদ্রে শয্যা পেতেছি কানাই ,আমার এখন আর শিশিরে ভয় নাই " .
কেন গো রাধে ,এমনতর ভাবনা। তুমি ত আমার পূর্বে অবস্থান কর। সকল জনে বলে রাধেকৃষ্ন। কৃষ্ণরাধে তো কেও বলেনা।
 বলে না ,সে কথা নয় ;শোন তবে ,বসন্ত আসার মাস কয়েক পূর্বে হঠাৎ অর্জুন বলে ,"আমি অর্জুন ,আর্য পুত্র আমি কুলীন। এক আকাশ আমার ছাদ। আমার দয়ায় এই গলি ঘুপচি তে তোমরা ঠাঁই পেয়েছো। মনে রেখো আমি ধন্বন্তরি ,মহা ঔষধী। "
অশোক ,পলাশ আর শিমুল কোনো প্রতিবাদ করেনি ঠিকই। মৃদু স্বরে বলে ,সব জানে শুধু রবি ঠাকুর পড়েনি। মনের প্রসার না হলে জীবনের বৃদ্ধি হয়না একথা তো কবি আমাদের শিখিয়েছেন। আমি আর পারুলও কিছু বলিনি এবং কষ্ট ও পাইনি। জানি ,নিজের অধিকার নিজেকেই বুঝে নিতে হবে।
-----------
বসন্ত, এক আকাশ আগুনকরা দিনে হাওয়ায় দুলে দুলে অশোক ,পলাশের হাত ধরে শিমুলের নাচন দেখে আপ্লুত। রাধাচূড়া আর পারুলের বিছানো পথে বসন্তের পায়ে পায়ে নূপুর বেজেছিল সে দিন। অর্জুন কাঁচুমাচু মুখে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। হয়ত ভাবছিল বসন্ত কেন আজ আর্য পুত্রের ঘরে নয়।গুমোর আছে অর্জুনের একথা তো অজানা নয় বসন্তের।
খানিক বাদেই এই পথেই অর্জুনের সাথে দেখা এক সাঁওতালি মেয়ের। কথার ফাঁকে মেয়ে বলে আমায় সকলে মেঝেন বুলেই ডাক পাড়ে। তুমিও তাই বোলো। হ্যাঁ গা ,তুমার বড়ই বড়াই শুনছি পথঘাটে। কানপাতায় দায় হৈছে ,তুমি বুলি আওড়াইছ ,তুমিই আর্য যার সকলই অনার্য।
শুনো তবে একখান বচন আমার ,এই মেঝেনের কৃষ্ণবরণ ,এর রূপ দেখে কবি গানই বাঁধলেন কৃষ্ণকলি। আবার তুমাকে লিয়েও নাটক বাঁধলেন। তুমার কত গুণ গান গাইলেন। এইবিটিনি আমার যা জ্ঞান গম্যি তাতে কবি বলেছেন তুমি আর আমি সুমান সুমান। কেও ছোটও লই কেও বড়োও লই।
মেঝেন বলেই চলেছে কথা ,অর্জুন মুগ্ধ হয়ে শুনছে। যেমন ধরো রাধাচূড়া আর পলাশ ,পারুল  তুমার লেগে রঙীন পথ কেটেছে। পথিক হাঁটতে লাগে যখুন ওঁদের পায়ে নূপুরের শব্দ হয়। ওরাও মজা পায়। পারুল আর রাধাচূড়ার  কত সুনাম করে লোকজনে । আর কি যেন বলে ,কন্ট্রাস্ট কালার না কি। পারুল আর রাধাচূড়ার বরণ দেখে ওই শহর থেকে যারা আসে ওরাই বলাবলি করে।  অত বুঝিনা তবে খুশী হয় এটা জানি।
তুমায় দেখার আগেই অলক্ষ্য রং লাগাই আকাশের গায়ে শিমুল ,পলাশ ,অশোক, কৃষ্ণচূড়া  ,রাধাচূড়া ,পারুল। পথিক সেই রঙে রঙিন হয়ে তোমার দ্বারে এসে দাঁড়ায়।
তুমি যখন বাকল ছাড়ো কি কদাকার লাগে ,তুমি জানো। কিন্তু এই পলাশ থেকে পারুল তোমার এই রূপকে ঢেকে দেয় তাদের রংয়ে।এই মেঝেনের কথায় একবার নিচে দেখো মাটির ওপর রঙের পথ আর একবার আকাশ পানে দেখো কেমন রঙীন আলো।
এই বলেই মেঝেন কখন  পলাইছে টের পাইনি অর্জুন। অর্জুন তো পলাশ থেকে পারুলের রূপে মুগ্ধ। এক ঘোরেই আছে। ডাক পাড়ে," মেঝেন  ও মেঝেন আরও বল কতকি জানিনা ,নিজের অহংয়ে আমি অন্ধ। তোমার জ্ঞানের রূপে আমি মুগ্ধ। আরও একটু বোস। দাও তোমার ব্যক্তিত্বের শীতল ছোঁয়া। আকণ্ঠ পান করি। "....
---------
 ওযে  চলে যাওয়ার সময় বলে গেল না। বাস্তবে ফিরেছে অর্জুন।মন খারাপ ওর চলে যাওয়াতে। এতদিন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। ঘাড় বাঁকিয়ে দেখা হয়নি প্রকৃতির রূপ। নেওয়া হয়নি রস ,গন্ধ।
অর্জুন ,পলাশ ,শিমুল ,অশোকরাও তো পুরুষ। ওদের তো কোনো বড়াই নেই। প্রতি বছর বসন্তের আশায় থাকে। নিজেদের পরিবর্তন করে ,যত্ন করে যাতে ফি বছর রঙে রঙে রঙীন হয়ে ওঠে। রাধাচূড়া ,পারুল কেও ওদের মতো থাকতেও দেয়।
আচ্ছা আমি কেন ভাবি সুখটা শুধুই আমার ,কষ্টটা ওদের। আজ বসন্ত আর কৃষ্ণকলি আমার চোখ খুলে দিয়েছে।
-------------
আমার মা না থাকলে আমার জন্মই হতো না। কে চিনত আমায়। পারুলরা না থাকলে আমার কাছে কেউ আসতো না। পথে পথে সুন্দর সজ্জার শয্যা কে পেতে রাখতো। আকাশের দিকে কে চেয়ে দেখতো পলাশরা না থাকলে।
মা আমার জন্ম দিয়েছে আর ওই মেয়ে ,কৃষ্ণকলি আমার জ্ঞান চোখে সাম্যের কাজল পড়িয়েছে। এরা সকলেই নারী। নাড়ির সংযোগ এই নারীর সাথে। মিছে অহমিকা আমার। মা।,মেয়ে ,ভাৰ্য্যা সকলই তো একজন। সে কে ?ও কে ?
মা কে ?সকলেই নারী। এই আকাশের অর্ধেক নারী আর অর্ধেক পুরুষ। ভাগের চিহ্নও চোখে পড়েনা। ভালোবাসা থেকে ভালোলাগার হেতু তুমি নারী। কেও আর্য ,অনার্য নয়। সকলই সমান।
এই শিক্ষা দিলো নাম না জানা মেয়ে। ও আমার পরম প্রাপ্তি ,ভালোবাসা আমার। জীবন এতো সুন্দর সে তুমি বোঝালে নারী। আর অহং নেই গো আমার। এসো নারী ,পুরুষ সকলে আমাদের জীবন উৎসব পালন করি। তুমি ছাড়া এ আকাশ অপূর্ণ। তুমি ?তুমি আমার অর্ধেক আকাশ। .......

















Friday 2 March 2018

যে জন আমার মনে 
#মৌসুমী রায়
শেষ পর্ব

তোয়ার কাছে  ওর বাবা , বন্ধু ,শিক্ষক ,সুখদুঃখের সাথী। কষ্ট হলে বাবার সাথে কথা বলে ,মন খারাপে বাবার কাছে কাঁদে। বাবা অজানা প্রশ্নের উত্তরের অভিধান। 
পয়া ছোটতে যে প্রকাশ গুলো করত সেগুলো সমৃদ্ধার মধ্যে নতুন করে খুঁজে পেত্। সমৃদ্ধা বেশ বড় হয়েছে। ও, ওর লেখাপড়ার জগৎ ,গান ,নাচ ,কবিতা নিয়ে ব্যস্ত। তোয়াও নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। মন কেমনের জায়গা একটু কম রেখেছে। ইদানিং সু কে যেন অন্যরকম ঠেকছে। আগে কক্ষনও এমন দেখেনি। আশাও করেনি পরিবর্তনের। তোয়া পরিবর্তনে বিশ্বাস করেনা। মানুষ তার নিজস্বতা নিয়ে বাঁচবে। অনুকরণ আর  হুবহু  অনুসরণের পরিপন্থী। সে যাই হোক। বয়সের ভারে সু ন্যুব্জ। কিন্তু তাঁর সৌন্দর্য  অটুট। সু চায় তোয়া ওকে মা বোলে ডাকুক। চোখের সামনে সমৃদ্ধা তোয়াকে মা ডাকে। কান যেন আরাম পায়। মা ডাকতে না দিয়ে তোয়াকে পৃথিবীর বিশাল সুখ থেকে বঞ্চিত করেছে। 

অর্থের প্রাচুর্য আছে কিন্তু সু আজ স্নেহ ,ভালোবাসার কাঙাল। কেমন যেন বাচ্চাদের মত। সমৃদ্ধা কে আদর করলে ওর ও আদর পেতে ইচ্ছে করে তোয়ার কাছে। অহংকারে তোয়ার ছোট থেকে বড় হওয়ার মুখ দেখা হয়ে ওঠেনি। সমৃদ্ধার বড় হওয়া সু দেখছে। ভাবছে তোয়াও তো এমন ছিল। অবসর তখন ছিল না ,এখন অনন্ত ,অখন্ড অবসর।
সমৃদ্ধা ওঁকে দিম্মা বলে। নাতনিকে খুব স্নেহ করেন। ওর বায়না ,আবদার সব সামলান দিম্মা। ওঁর ইচ্ছে সমৃদ্ধার জন্মদিন এ  এবার আড়ম্বর হবে। বন্ধু ,বান্ধব আসবে। তারমধ্যে বিশেষ বন্ধুকে সু পরখ করতে চায়। সে যেন মানুষ হয়। তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকে উপলব্ধি। শুদ্ধসত্য যেমন ,ঠিক তেমন যদি নাতনির জীবন সঙ্গী হয় তাহলে বেশ হয়। নিজের মনে নিজেই বলে। বাইরে বলতে ইচ্ছে থাকলেও বলতে পারেনা। সাহস নেই সত্যের মুখোমুখি হওয়া।

জন্মদিনে খুব আনন্দ ,মজা হল। মিনতির আজ খুব পরিশ্রম হয়েছে। ওর ও বয়স হয়েছে। এই বাড়িতে ওর মায়া পড়ে গিয়েছে। ইচ্ছে এদের সাথে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। সমৃদ্ধা ওকে ছাড়তে চায়না। মিনতি ঘুমিয়ে পড়েছে। সমৃদ্ধাও নিজের ঘরে।সু ওষুধ খায় নানান অসুখের আর ঘুমের ওষুধ  ও খায়। আজ তোয়া দিলে সেটা সরিয়ে রাখে। বলে "আজ একটু আমার পাশে বোস তোয়া ,অনেক কথা আছে ;আজ সব বলব ,না বললে কোনদিন আর বলতে পারবনা "...
তোয়ার চোখ এ ঘুম এসেছে ,তবুও সে শুনতে চাই ওঁর কথা।
সু তোয়ার মাথাটা নিজের কোলে টেনে নেয়। চুলে আঙুল দিয়ে আদর করছে। তোয়ার নতুন কোরে সু কে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে ,মা বলতে মন চাইছে। এতো বড় হয়েছে ওঁর কাছে মায়ের আদর এই প্রথম।
"জানিস তোয়া ,অহংকার আমায় সন্তান ও স্বামী সুখ থেকে বঞ্চিত করেছে।পয়াকে খুব মনে মনে মিস করি। ও আমার অবহেলার শিকার। শুদ্ধসত্যর চলে যাওয়া চোখে পোটি বাঁধার অভিনয়। ওঁ তো যায়নি ,আমি ওকে চলেযেতে বাধ্য করেছিলাম।  ওঁর খাবারে  বিষক্রিয়ায় আমিই দায়ী। তুই যে শীর্ষ কে ভালো বাসতিস সে আমার অজানা ছিল না। অজানা নয় শীর্ষর তোর প্রতি ভালোবাসা। আভিজাত্যের মোহে ,অর্থের মোহে অন্ধ ছিলাম। পাছে শীর্ষর সাথে বিয়ে হলে আমার আভিজাত্যে ঘুণ ধরে। ওদের অনেক টাকাপয়সা দিয়ে এই বাংলা ছেড়ে অন্যত্র পাঠিয়ে ছিলাম। জানিনা কেমন আছে। তোর বিয়ে একটা মানসিক অসুষ্থ ছেলের সাথে দেওয়া আভিজাত্যের বড়াইয়ের আর অর্থের লোভে। তোর মত গুণের মেয়ের সর্বনাশ এর হাতেই। নিজের স্বামীর ভালোবাসা ছেড়ে পরের ভালোবাসায় ভাগবসিয়ে ছিলাম। ঈশ্বর তার ঠিক বিচার করেছেন আমার প্রতি। অন্যায় টা তো অন্যায়। যখন বোধগম্য হোল তখন সবশেষ।
এখন আমি তোর মা ডাক শুনে যেতে চাই তোয়া। একবার মা বলে ডাক। তোয়া কঠোর হতে পারল না। মায়ের কান্না এই বয়সে সহন হয়নি। মা বলে আর অঝোরে কাঁদে। তোয়াকে মা আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। একটা আবদার রাখবি ?,
  যে ছেলেটি সমৃদ্ধার খুব কাছের বন্ধু ও আমার খুব পছন্দের। ওর মধ্যে আমি শীর্ষ কে খুঁজে পেলাম। তুই শুধু মত দে। "...
শুনতে শুনতে মা ,মেয়ে চোখের জলে ধুয়ে যাচ্ছে। সমৃদ্ধার ওকে পছন্দ তোয়া জানে। ওদের বিয়েতেও তোয়া মত দিয়েছে  আগেই। সু অমত করলেও এই বিয়ে হতই। মায়ের ডাকে  তোয়া "মা "...বোলে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে  কান্নায়  ভেঙে পড়েছে। ভোর হয়ে গিয়েছে ,বাইরে পাখিদের কলকাকলি। বারান্দায় আজকে হাওয়াটা খুব মিষ্টি লাগছে তোয়ার।   এই শতাব্দীর নতুন সকালের নতুন সূর্যের কিরণে মা মেয়ে নতুন স্নান সেরেছে।কত কাজকম্ম বাকি। আজ একটু তাড়াতাড়ি হাত চালাতে হবে।



















Saturday 24 February 2018

যে জন আমার মনে 
#মৌসুমী রায় 
(৩)
তোয়া আর শীর্ষর মনের খুব মিলান্তি। দুজনেই আবৃত্তি ,গান এই নিয়েই ছুটির দিন কাটায়। দিম্মির সাথে সময় কাটে বাবা আর পয়ার কথা বলে। সু এইসব শুনতে চাইও না ,সময়ও নেই ওর। আকাশে মেঘ করলে একছুট্টে ছাদে ওরা দুজন। কখনো মেঘ ,বৃষ্টি আবার কখনো ফুল প্রজাপতি হয় ওরা। কত খেলা মনের খেলা ঘরে। খেলা কখন যেন ভালোলাগা আর ভালোবাসায় পৌঁছে গিয়েছে। বাবা চলে যাওয়ার পরে এমন করে কেউ বাসেনি। দিম্মি টের পায়। বলতে চায় ,সতর্ক করতে চায় ঠোঁটে আগল পড়ে যায়। ভয় হয় ,এবাড়ি থেকে চলে যেতে হলে কোথায় যাবে এই বয়সে নাতিকে নিয়ে। 
সু অত্যন্ত জেদি ,তেজী এবং গুণী। গান ,কবিতা পড়া ,লেখা সবেই তুখোড়। মেয়েকেও সেইভাবে তৈরী করছে।একদিন হঠাৎ সু দিম্মিকে বলে "নতুন এক হাউস কিপার রেখেছি ,তোমরা আর এখানে থাকছ না ,নতুন কাজ খুঁজে নাও "...
কোনো গন্ডগোল হয়নি ,তোয়ার যত্নআত্তি খুব করে ,সু এর সুবিধে অসুবিধে সব খেয়াল রাখে।  কেন ওরা চলে যাবে ?সু কে তোয়ার প্রশ্ন করার ক্ষমতা ,ইচ্ছে কোনটায় নেই। সেদিন দিম্মির কোলে মাথা রেখে তোয়া খুব কেঁদে ছিল। দিম্মি শুধু মাথায় হাত বোলাতে থাকল আর নিজেও চোখের জল ফেলতে লাগলো। শীর্ষ কে তোয়া আর শীর্ষ তোয়া কে ভালোবেসেছিল। ওরা চলে যাওয়ার পরথেকে আজ পর্যন্ত কোন খবর তোয়া পায়নি। কোথায় যে গেল ,কোথা হারালো কে জানে।
মিনতি পিসি তোয়াকে নিজের সন্তানের মত ভালোবাসে। সবাই তোয়াকে খুব পছন্দ করে। ওর আচার ,বিচার ,ব্যবহার বাবার মত।বাবাও ছিলেন সুপুরুষ। তোয়া ওর বাবার মত দেখতে সবাই বলে। শুদ্ধসত্য একমাত্র সন্তান হাওয়ায় কোনও তুতো কেও ছিলনা। মিনতি পিসিও খুব দুঃখী। অনাথ মেয়ে। দত্তক কন্যা হিসেবে মানুষ হন। পালিত বাবা ,মা খুব ভালোবাসতেন। তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা সেরকম নয়। বয়স এর সাথে প্রকৃতির নিয়মেই তাঁদের চলে যাওয়া। মিনতি পিসি বিয়ে থা করেনি। একটা এজেন্সি তে কাজকরে। ওখানথেকেই তোয়াদের বাড়িতে পোস্টিং।
সু ওর বন্ধুর ছেলের সাথে তোয়ার বিয়ে ঠিক করেছে। যে সু এর সাথে থাকে ওর মানসিক বিকাশহীন ছেলের সাথে।
তোয়ার সঙ্গে একদিন ওর বিয়ে হয়ে যায়। শ্বশুর বাড়িতে আশীর্বাদ এ  উপহার সুসজ্জিত মোড়কে থাকলেও উপহার সামগ্রী মনগ্রাহী ছিল না।
তোয়ার স্বামীর নাম সুপ্রিয়। ও মানুষ হিসেবে খুব ভালো। সব বোঝে ,কে ভালোবাসে ,কে বাসেনা। কে অবহেলা করে ,সব সব , সমস্ত কিছু। তোয়াকে ওর খুব পছন্দ। এতেও বাড়ির অন্য সদস্য দের হাসি মজা সব কিছুই সহ্য করে তোয়া।
একটাই মিশন সুপ্রিয়র অধিকার ওকে ফিরিয়ে দেওয়া। কয়েক বছর পরে তোয়ার একটি ফুটফুটে মেয়ে হয়।
বাড়িতে তুমুল অশান্তি ,সম্পত্তির ভাগীদার এসেগেল। সুপ্রিয় মেয়ের সাথে বাচ্চাদের মত খেলাকরে। মেয়ে বড় হচ্ছে। তোয়ার বুদ্ধি টা মেয়ে পেয়েছে। সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে তুমুল অশান্তি। সুপ্রিয়র বাবা , সু কে কিছু দেবেন ,আর বাকিটা দুই ছেলের। যাই হোক সু কোনও সম্পত্তি পায়নি আইনি জটিলতায়।
তোয়া শশুরবাড়ির সম্পত্তি নিয়ে সু এর সাথেই থাকে। সুপ্রিয় বেশিদিন বাঁচবে না জেনেও সু তোয়ার বিয়ে দিয়েছিল। অর্থের লোভ আর দম্ভ এর কারণ। সুপ্রিয় আর ওর বাবার চলে যাওয়া বছর ঘোরেনি।
এখন তোয়ারা সেই ত্রিকোণমিতি। সু ,তোয়া আর  মেয়ে সমৃদ্ধা। ক্রমশঃ......







  


Friday 23 February 2018

যে জন আমার মনে 
#মৌসুমী রায় 
(১)
দশ বছরের মেয়েটি বাবা কে জিজ্ঞেস করে "বুদ্ধ্যঙ্ক  আর মানবিক অঙ্ক অর্থ কী ?"প্রধান শিক্ষিকা বলছিলেন মেয়েরা বলো তো। বুদ্ধ্যঙ্ক  মানে অনেকে বললো আই কিউ কিন্তু মানবিক অঙ্ক সেই ভাবে অর্থ  হয়নি। তুমি  
বলে দাও বাবা। মেয়ে স্বচ্ছতোয়ার প্রশ্নে বাবা শুদ্ধসত্য জেরবার। মেয়ের বাড়ি ফিরে সময় চলে একরত্তি বোন পয়মন্তি র নানান অভিব্যক্তির অর্থ কি হবে তার গবেষণা ,নিজের পড়াশোনা আর বাবা বাড়ি ফিরলে সব প্রশ্নের সমাধান বাবার মস্তিষ্কের  প্রযুক্তি বিদ্যায়। ওরা তিনজন খুব খুশি থাকে যখন শুধুই তিন থাকে। বাবা মেয়েকে বলতেন আমরা জ্যামিতির একটা চরিত্র জানিস তোয়া। তুই ,পয়া আর আমি। আমরা ত্রিকোণমিতি ,আমাদের বাড়িটা পিরামিড। আমরা "মমি "বলেই হাততালি আর হাসির ফোয়ারা ,সেই দেখে দু বছরের পয়া ও তাল দেয়। ও যেন কত বোঝে। 
শুদ্ধসত্য বই এর  ব্যবসা করেন। রাত্রে তোয়া খাবার খেয়ে ঘুমোয় না। একজন হাউস কিপার আছেন তিনি বাড়ির সব কাজ কম্ম করেন ,বাজার ঘাট ,ডাক্তার ,ওষুধ  পয়া কে দেখা শোনাও সমস্ত। 
তোয়া প্রতি রাত্রে বাবার কাছে গল্প শুনবে তবে ঘুমোবে। কত রকমের গল্প। আজ আবার একটা প্রশ্নও আছে। দরজার ঘন্টা টা আজ বাজছেই না। ধুর ভালো লাগেনা  "বাবা যে কেন দেরী করে ?"অমনি দরজায় ঘন্টা। বাবা এলো। হাতমুখ ধুয়ে খাবার খেয়ে বাবা গল্প শুরু করবে কিন্তু আজ প্রশ্ন টা আছে ,ওটা জেনে তবে গল্প। 

বাবা বললেন বুদ্ধি টা ঠিকই আছে। মানবিক অঙ্ক হল এক বিশাল পৃথিবীর সদস্য হওয়া। পড়াশোনার সাথে সাথে নিজেকে তৈরী করা। আমাদের দেহে পঞ্চ রস আছে। ক্ষিতি ,অপ ,তেজ ,মরুৎ আর ব্যোম। ব্যোম ব্যোম ভোলে হা ,হা ,হা।বড় হতে হতে বাতাস ,জল ,আগুন , মাটির  আস্বাদ নিতে হবে। জল খাবার সময় জলের স্বাদ নিতে হবে। যোগ ব্যায়াম করতে হবে। দেহের সাথে মনের শুদ্ধিকরণ হবে। দুইয়ের মেলবন্ধনে গড়ে উঠবে মানবিকতা। যে অন্যের পাশে দাঁড়াতে শেখাবে মানুষকে। অসহায়ের সহায় হবে ,অনাথের নাথ হবে। উপকার করার চেষ্টা করবে। প্রকৃত মানুষ হবে। বুদ্ধি, মন দুয়ের মিলনে হয় মানবিক অঙ্ক।
(২)
রোজনামচা  বাপ্ ,বেটিদের। কত গল্প বাবা মেয়েদের বলে তার শেষ নেই। কখন কখন বাবা শুধায় তোরা কার ছানা ,বিড়ালের না বাঁদরের। তোয়া বলে কেন আমরা মানুষের ছানা ,ওদের হব কেন। বাবা বলে শোন তবে একখানা গল্প বলি। মানুষের ছানাদের ও এই দুই প্রবৃত্তি হয়। এই যেমন বাঁদরের ছানাদের জীবনের ঝুঁকি আছে বিস্তর। বাঁদর এ ডাল ,ও গাছ দৌড় ঝাঁপ করে ,তার বাচ্চা বাঁদরের পেটটা শক্ত ভাবে ধরে থাকে ,নচেৎ পড়ে গিয়ে হাড় ভাঙবে নয়ত মৃত্যু।
আর বিড়াল মা তার ছানা গুলো র ঘাড়ের কাছটা কামড়ে ধরে বাড়ির নিরাপদ জায়গায় রেখে দেয়। বাড়ির মানুষেরাও তাদের দেখভাল করে কখন সখন। জীবনের ঝুঁকি অনেক কম। তোয়া বলে আমাদের জীবন বাঁদরের হতে হতে আপাতত বিড়ালের হয়েছে। বাবা মুচকি হাসেন। কি বল ,আমরা কলমি শাকের দল। একটা টানলেই গোছা শুদ্ধ হাজির। কিছু না বুঝেই পয়ার হাত তালি।
তোয়ার  বয়স আঠেরো। সে আজ একা ,কত কথা ,গল্প ,বাবা ,পয়া সব মনে পড়ে। সেইদিন বাবার বাড়ি আসতে খুব দেরী হয়েছিল। আষাঢ়ের কালো মেঘে বৃষ্টি এসে ছিল ,থামার নাম গন্ধ নেই। পয়ার ধুম জ্বর কিছু তেই কমে না। ডাক্তার ও আসছে না। মা কে পাওয়া যাবে না। প্রতিদিন তার পার্টি ,খানাপিনা। নামি দামি লোকজনের সাথে ওঠা বসা। আজ বাবা প্রায় তিন থেকে চার ঘন্টা দেরি তে বাড়ি এল। ততক্ষনে পয়া নেতিয়ে পড়েছে। ডাক্তার এলেন ,জবাব দিলেন। সেইদিন ত্রিকোণমিতির একটি কোণ ভেঙে গেল। দিনযায় ,রাত যায় তোয়ার পয়ার সেই ছোট্ট বেলার শুয়ে থাকা,হাত ,পা নড়ান সব মনে পড়ে। ঘুমের মাঝেও ঠোঁটের কোণে হাসি থাকত। ও সেভাবে মাকে পায়নি। তোয়াও ।
চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখতো ,না বশে থাকা হাত দুটো দিয়ে সব কিছু পেতে চাইত। মুঠি করা হাতদুটি তোয়া খুলে দেওয়ার চেষ্টা চালাত ,কিন্তু আবার মুঠি হয়ে যেত। মুঠি হাতে কতকিছু দিতে চাইত। কালে ভদ্রে মা গালটা টিপে দিত।
তোয়া আর পয়া মা কে কোনদিন মা বলেনি। তোয়া এখনও। ওকে" সু "বলতে হত। সুচরিতার সু।  মা ডাক ওর পছন্দ নয়। বাড়িতে মাঝে মাঝে একটা লোক আসত। ও ,পয়া আর তোয়া কে  চকলেট দিত। ইদানিং আর দেয় না। তোয়া এখন চকলেট চাইও না।  পয়া চলে যাওয়ার পরে পরে খুব ঘনঘন আসে। তোয়া পছন্দ করেনা। বাবার মত শান্ত মানুষ ওকে দেখে কেমন বদলে যেত। ওই লোকটার সামনেই বাবাকে সু যা নয় তাই বলত। দিনদিন বাবা কেমন হয়েযেতে লাগল। পয়া যখন বারো বছর ,হঠাৎ বাবার বমি পায়খানা আর থামে না। ডাক্তার ও বাবাকে দেখে বললেন খাবারে বিষাক্ত কিছু মিশেছিল সেই খেয়ে এমন হয়েছে ,করার কিছুনেই। সবশেষ হয়ে যাবার পরে সু আর ওই লোকটা এসে ছিল।
কয়েকদিন পর ওই হাউস কিপার কে ছুটি দিয়ে দেওয়া হল। বাড়িতে এলো একদিম্মি আর তার অনাথ বছর চোদ্দোর নাতি । সু প্রথমে আপত্তি করেছিল নাতি আসাতে। কিন্তু দিম্মি অনড়। তাই সম্মতি। ওর নাম শীর্ষ। সু একটা স্কুলে শীর্ষ কে ভর্তি করল।  শনি রবি তোয়া বাড়িথাকে। কবিতা শেখে। শীর্ষ আড়াল থেকে দেখে ,শোনে।
সু আর ওই লোকটা এখানেই থাকে। লোকটার অনেক অর্থ,সম্পত্তি । ওর অন্য বাড়িতে দুটি ছেলে আছে। একটি সাধারণ , বাবার ব্যবসা দেখে। ছোট টার মনের বিকাশ পূর্ণতা পায়নি।ক্রমশঃ ....













Sunday 28 January 2018

দুই বিনুনী 
#মৌসুমী রায় 
এই সেদিনের মেয়ে ,আজ বয়স বারো  হলো। সরস্বতী পুজোয় ওর নাচের অনুষ্ঠান  হবে বাড়িতে এবং স্কুলে ,সাথে গান ও গাইবে মেয়েটি । তোড়জোড় শুরু ,পুজোর  সামগ্রীর সাথে সাথে ঠাকুর আসবে বাড়িতে। সেই ছোট্ট মেয়ে আজ শাড়ি পড়বে। বসন্ত পঞ্চমীর  শুক্ল পক্ষে, আদরের বাড়ির ছোট্ট সরস্বতী। বাসন্তী রঙে লাল পেড়ে শাড়ি ,কপালে সাদা রঙের  কলকা এঁকে গোল টিপ্ লাল রঙের  আর তার সাথে দুই বিনুনি খেজুর ছড়ি শৈলীতে বাঁধা। সেটিকে বেড়া বিনুনী বেঁধে পলাশ  মালা জড়ানো থাকবে। কানে পলাশের দুল ,হাতে পলাশের বালা ,আর নাকে পলাশের বেসর এবং গলায় পলাশের মালিকা। বাজু বন্ধনী আর কোমর বন্ধনীও পলাশ মালিকায়।  এই বেশ ভূষণ  সজ্জা  পরিকল্পনা মেয়েটির দাদুর। আর কপালে টিকলি থাকবে ,সেটাও ওই পলাশের। 

কয়েক দিন ধরেই চলছে রিহার্সাল বাড়িতে। মধুর মধুর ধ্বনি আর আজি কমল মুকুল দল খুলিলো  গানের সাথে নাচ  অনুশীলন। মাঝে মাঝে দাদু নাতনিকে নাচের ভঙ্গিমাও দেখাচ্ছেন। কমল মুকুল দল খুলিল গানের কথায় দুটি হাত ঘুরিয়ে প্রথমে কুঁড়ি মুদ্রায় এনে ফুটিয়ে তোলার মুদ্রা আনতে হবে।মধুর মধুর ধ্বনিতে বীণা বাদন ভঙ্গীতে নৃত্য প্রদর্শন।   বলে রাখি দাদু নাচের কিছুই জানেন না। কিন্তু রবি ঠাকুর তাঁর প্রিয়। সুতরাং নাচটাও তাঁর মনে হয় নাতনী এই ভাবে নাচলে বুঝি সুন্দর প্রদর্শন হবে। প্রায় ঘন্টা খানেক নাচের অভ্যাস চলত। আর গান এর অভ্যাস  ও চলত ঘন্টা খানেক। সঙ্গত করতো মেয়েটির কাকা। তিনি ভালো তবলা বাজাতেন। লোকে মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে শুনতো। আরও একটি গুণ তাঁর অপূর্ব যাত্রাভিনয়। মঞ্চে উঠলে সবাই তাঁকেই দেখতেন। যেমন তাঁর বাচন ভঙ্গী তেমন স্পষ্ট উচ্চারণ। হ্যাঁ ,ওইযে বলছিলাম গানের সঙ্গত করার সময় কাকার তবলার বোলে শেষ তেহাই টা আজও মেয়েটার স্মৃতিতে। মেয়েটি তাঁর দাদু এবং কাকার তালিমে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে।  এভাবেই অনুশীলন চলত। থেকে থেকে আনন্দে বলতেন দাদু ,আসলের চেয়ে সুদ মিষ্টি একেই বলে বুঝলে নাতনী। তুমি আমার সংসারে হঠাৎ ভেসে আসা ধন নও ,তুমি আমার অন্তরের অন্তহীন ভালোবাসার ধন। বলেই একটা চারমিনার সিগারেট ধরাতেন ,আর সুখটান দিতেন। একেবারে সিগারেটের শেষ টান অব্দি টানতেন। বাম হাতের মধ্যমা আর তর্জনী উপরের কর দুটি তামাক রঙে রাঙানো।
দাদুর একটা বেগুন ,এই সিগারেট পান করা। বাড়ির নিষেধ শুনতেন না। ছোট্ট নাতনী তখন জানত না এটা ভাল নয় শরীরের পক্ষে।  

মাস খানেক ধরে চলত কঠোর অনুশীলন ,গলার জন্য চলত কসরত। গার্গেল করা ,নীচু স্কেল এ ওম উচ্চারণ আর গলা সাধা।  আচার বা টক জাতীয় কিছু খাওয়া যাবেনা। ঠান্ডা লাগানো যাবেনা ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেকে এই নিয়ে হাসাহাসি করত আড়ালে। মাঝে মাঝে এ ভাবেই চলত  দাদুর দেখভাল আর পরামর্শ। রবিঠাকুরের গানের সঞ্চারী তে নৃত্যের ভঙ্গিমা কেমন হবে। সঞ্চারী কিন্তু গানের মর্ম কথা ও সুরের অপূর্ব মেল্ বন্ধন ,নাচ টা সেই ভাবে পরিবেশন করতে হবে। মাঝে মধ্যে চলছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি। অন্য সদস্যদের পরিবেশন। সেখানেও দাদুর অনুশীলন। কোথায় কোথায় গলার ওঠা নামা ,গম্ভীর এবং স্পষ্ট উচ্চারণ।
থেকে থেকে সাজসজ্জার কথা উঠলেই বার কয়েক নাতনীর দুই বিনুনী আর পলাশের মালার পুনরাবৃত্তি।এর আয়োজনে ত্রুটি না হয়। হলেই কেলেঙ্কারি ,একেবারে যাকে বলে দক্ষ যজ্ঞ।

পরিবারে কর্তার আনন্দ আর সদস্যদের আনন্দের যৌথ কলস পূর্ণতা লাভ করলো। আনন্দ ধ্বনির প্রতিধ্বনিতে উপচিয়ে পড়ছে খুশী। খুশী গুলী কত আল্পনায় পথ এঁকেছে। গন্ধের ম ম ,বসন্তের বাতাসের মত বইছে। আজকের মতো খুশী দাদুকে কখনও দেখেনি বাড়ির সদস্যরা। আজ সত্তরের দাদু যেন সাতাশের প্রাণোচ্ছল যুবক। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা ,শীতল ষষ্ঠীর কলায় সেদ্ধ ,সব মিলিয়ে এক উৎসব বটে।
স্কুলের অনুষ্ঠান পুজোর দিন। সেদিনের দুই বিনুনী বাঁধা ,ফুলের সাজ সেটাও দাদুর দেখভালে। ওই অনুষ্ঠানে সকলে খুব খুশী। তার সাথে প্রশংসা চুলের প্রসাধনের। পরের দিন বাড়িতে অনুষ্ঠান ,অনেকে উপস্থিত। সকল সদস্যদের অনুষ্ঠান পরিবেশন এবং তাঁর প্রিয় নাতনীর নৃত্যানুষ্ঠান।বিনুনী মেয়েটির মা যত্নে বেঁধে ছেন। ছোট্ট পায়ে আলতা পড়েছে। হাতেও আলতার আঁকিবুকি। বেশ লাগছে মেয়েটিকে। একেবারে বিয়েতে কনের সাজে। ঠাকুমা ,মা ,কাকীমা কনিষ্ঠা র নখে দাঁত ঠেকিয়ে কি সব করল। নজর না লাগে।
দুই বিনুনী খুব শক্ত ভাবে বন্ধনে আবদ্ধ ;আর ফুলের মালারও অটুট বন্ধন। দাদু খুশী। নাতনী তাঁর মনের মত অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছে।
অনুষ্ঠান শেষে দাদু কিছু কথা পরিবেশন করেন। তিনি বলেন ,"দেখা না দেখার মাঝে কতই স্মৃতি সুধা ,আজকে নগদ কালকে ধারের সুখের সুতোয় বাঁধা। বারে বারে বাঁধব তোমায় জনম জনম ধরে ,হাসি খুশী থেকো সবাই শুধুই যোগের ঘরে। থাকবনা যখন আমি দেখবে নতুন সূর্য নতুন ভোর ,এই আশাতেই ভরুক ভাবনা মোর। ভালোবেসো সকল জনে মনে প্রাণে ,কর্মে মৃত্যুঞ্জয়ী হোক তোমার আমার ভালোবাসার টানে ".....
বলেই দাদু  চোখ দুটি অঝোরে বইতে লাগল অশ্রু নদী। স্তব্ধ সবাই কেও করতালি দিতে গিয়েও পারলনা।
ধাতস্থ হয়ে দাদু আবার বলে গেলেন তাঁর বাড়ির এতো দিনের পরিশ্রমের কথা। আর বললেন এই দুই বিনুনী বাঁধা নাতনীর কথা। অনেক দিনের সাধ ছিল বাড়িতে এক কন্যা সন্তানের আগমন। নাতনী সেই বাসনা পূর্ণ করেছে।
এক প্রত্যন্ত গ্রামের দাদু নাতনীর যুগলবন্দী গ্রামবাসীদের আনন্দ দিয়ে ছিল সেইদিন। মন্ত্র মুগ্দ্ধ অনুষ্ঠানের পর সকল গ্রামবাসীর মুখে মুখে ধ্বনিত , পরিবারে মেয়েদের সৌন্দর্য  ই আলাদা। মনে মনে প্রত্যেক পরিবার দুই বিনুনী বাঁধা মেয়েটির শুভ কামনার সাথে তাঁদের পরিবারে কন্যা সন্তানের আগমনের কামনা ও জানিয়েছিল। 

  

Tuesday 9 January 2018

নববর্ষ 
#মৌসুমী রায় 
পদ্মাসনে স্বাগত নববর্ষ ,তুমি তোমার তরঙ্গ কল কল্লোলে। 
ক্ষুদ্র চাওয়া পাওয়ার উর্দ্ধে আজ সকল হৃদয় দোদুল দোলে।।

বছর ভরে ,স্তরে স্তরে আশা আকাঙ্খায় যতনে সাজানো ঝাঁপি। 
বে -হিসেবি ,পূর্ণ -অপূর্ণের ডালি অংকে রাখেনি মাপি।।

এস বন্ধু হয়ে ,নম্র বয়ানে আমার নত নয়নের কোলে পৃথিবী পরে। 
যা কিছু হারিয়েছি জানি সে পূর্ণ হবেনা এ ভবের সংসারে।। 

তবুও হে অনন্ত নিখিল তোমার ভালোবাসা রাখার আধার অফুরন্ত। 
দুখের মাঝেও চিনি যেন তোমার সুখের  বিশালতার  অনন্ত।। 

হে সুন্দর নিয়ত নব রূপে এস মনের কোণের হৃদয় আসনে। 
দিন রাত্রি যাপন করি নববর্ষ রূপে দেহে লালনে  মনে যতনে।।   

সময় হয়েছে মানবজাতির নববর্ষ কে বাঁধতে নতুন অঙ্গীকারে। 
শত অবাঞ্ছিতের মাঝেও আমরা দিয়ে যাব  নবীন বসতি আগামীরে।।  

Thursday 4 January 2018

পৌষাললো 
#মৌসুমী রায়
বীরভূমের মেয়ে হওয়ার সুবাদে  বীরভূমের অনেক টুকরো স্মৃতি আজও স্মৃতিপটে। বোধকরি শীতের স্মৃতি একটু বেশিই টাটকা। আমাদের গ্রামের বাড়ি একান্নবর্তী। শীতের ছুটিতে খুড়তুতো ,পিসতুতো ভাইবোনদের সমাগম। আমার বাবা বড় ছিলেন তাই জেঠতুতো কেও ছিল না। শীতের আমেজে এমনই টাটকা হতাম যে বিদ্যালয়ের ছুটি পেরিয়ে গেলেও কোনো হেলদোল থাকত না। যে এবারে শহরে ফিরতে হবে ,আবার নতুন ভাবে সব শুরু করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ফেরার সময় দাদু ,ঠাকুমা ,বড়মার জন্য মন খারাপ  করত। ও হ্যাঁ বড়মা আমার দাদুর মা। ফেরার দিন গরুর গাড়িতে করে বাস স্ট্যান্ড আসতে হত তখন। ফিরে  আসার দিন দাদু সদর দরজায় চুপ করে বসে থাকতেন। অন্য দিনের মতো হাঁক ডাক নেই তাঁর। বড়মা আমাদের বাড়ির আমতলায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন। গরুর গাড়িতে যাওয়ার সময় গাড়িথেকে যতদূর দেখাযায় সে আমার ঠাকুমার চোখের জলে ভেজা মুখখানা। খুব মন খারাপ আমাদেরও। আরও মনে আছে গ্রামের বাড়িথেকে যে জামাকাপড় গুলো আনতাম তার গন্ধ শুঁকতাম। আর বাড়ির গন্ধ পেতাম। 

হ্যাঁ ওই যে বলছিলাম শীতের কথা। সে বেশ লাগত জানো। ভোরের সূর্য আলো দেওয়ার আগে আমাদের বাড়ির কাজ করত গোবর্ধন কাকা মাটির হাঁড়িতে করে ধোঁয়া ওঠা খেজুরের রস নিয়ে আসত। আশ মিটিয়ে খাওয়া হত। যতদিন শীতের ছুটি ততদিন ওই খেজুর রস। আহা কি মিষ্টি ,কি সুস্বাদু কি বলব। 
খানিক বাদে রোদ উঠতেই কাঠের উনুনের আঙ্গারে কালো কালো বেগুন পুড়িয়ে ভালো করে সর্ষের তেল ,কাঁচালঙ্কা ,পেঁয়াজ দিয়ে মেখে বেগুনপোড়া আর মুড়ি খাওয়া। তখন জল খাবারে রুটি ভাবাই যেতনা।
তার উপর পিঠে ,পুলি তো ছিলই। সেই পিঠের চাল গুঁড়ো হত ঢেঁকিতে।ঢেঁকি পাড় দেওয়াও যেন কি মজার। আর একজন ঢেঁকির পাড়ের তালেতালে চালগুলোকে ইস্পাতের পাত দিয়ে ঘেরা গর্তে  হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওলট পালট করতেন। সেও এক শিল্প না দেখলে বোঝা যাবেনা। তালে তালে হাত না ঘোরালে   হাত কেটে একেবারে ফালাফালা হয়ে যাবে। ঢেঁকি পাড়ের সাথে সাথে চলত বীরভূমের মাটির গান।

এছাড়াও আরও একটি শীতের আনন্দ পৌষাললো। পৌষ মাসের বনভোজন। পৌষের মিঠে কড়া রোদ মেখে নতুন ধানের চালের ভাত ,শীতের সবজি আর হাঁসের ডিমের ঝোল খাওয়া। বাড়িথেকেই সব জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে গ্রামের শেষ প্রান্তে কেটে নেওয়া ধানক্ষেতে রান্না বান্না করা হতো । আর হ্যাঁ রান্না করার পূর্বে যে উনুন তৈরী হতো তার পাশেই মাটিদিয়ে একটা লাফিং বুদ্ধর মত দেখতে মূর্তি গড়া হতো। সেটি আসলে ভৈরব মূর্তি। আগুন জ্বালানোর পূর্বে আনাজপাতি সব উৎসর্গ করা হতো। নির্বিঘ্নে পৌষাললো সম্পন্ন করার তাগিদে। কোনও জৌলুস ছিলোনা। ছিল মনের তৃপ্তি। সূর্য ডোবার পূর্বে বাড়ি ফেরা। আজকের দিনে গ্রামের বাড়ির স্মৃতি হাতড়ে মরি। হাজার বার চাইলেও ফিরে পাবনা সেই দিনের শীতের আনন্দের অনুভূতি।