Tuesday 13 March 2018

অর্ধেক আকাশ 
#মৌসুমী রায় 
ওই দূরে দাঁড়িয়ে বিশালাকার অর্জুন। তাঁর চারপাশে পরিবেষ্টিত হয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া ,রাধাচূড়া ,অশোক ,পলাশ আর পারুল এবং খানিক তফাতে শিমুল। কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচুড়া পাশাপাশি থাকায় মৃদু কন্ঠে বাক্যালাপ চলছে। ভালো ,মন্দ সব মিলিয়ে জুলিয়ে। হঠাৎ ছন্দপতন ,রাধাচূড়া বোলে ওঠে "সমুদ্রে শয্যা পেতেছি কানাই ,আমার এখন আর শিশিরে ভয় নাই " .
কেন গো রাধে ,এমনতর ভাবনা। তুমি ত আমার পূর্বে অবস্থান কর। সকল জনে বলে রাধেকৃষ্ন। কৃষ্ণরাধে তো কেও বলেনা।
 বলে না ,সে কথা নয় ;শোন তবে ,বসন্ত আসার মাস কয়েক পূর্বে হঠাৎ অর্জুন বলে ,"আমি অর্জুন ,আর্য পুত্র আমি কুলীন। এক আকাশ আমার ছাদ। আমার দয়ায় এই গলি ঘুপচি তে তোমরা ঠাঁই পেয়েছো। মনে রেখো আমি ধন্বন্তরি ,মহা ঔষধী। "
অশোক ,পলাশ আর শিমুল কোনো প্রতিবাদ করেনি ঠিকই। মৃদু স্বরে বলে ,সব জানে শুধু রবি ঠাকুর পড়েনি। মনের প্রসার না হলে জীবনের বৃদ্ধি হয়না একথা তো কবি আমাদের শিখিয়েছেন। আমি আর পারুলও কিছু বলিনি এবং কষ্ট ও পাইনি। জানি ,নিজের অধিকার নিজেকেই বুঝে নিতে হবে।
-----------
বসন্ত, এক আকাশ আগুনকরা দিনে হাওয়ায় দুলে দুলে অশোক ,পলাশের হাত ধরে শিমুলের নাচন দেখে আপ্লুত। রাধাচূড়া আর পারুলের বিছানো পথে বসন্তের পায়ে পায়ে নূপুর বেজেছিল সে দিন। অর্জুন কাঁচুমাচু মুখে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। হয়ত ভাবছিল বসন্ত কেন আজ আর্য পুত্রের ঘরে নয়।গুমোর আছে অর্জুনের একথা তো অজানা নয় বসন্তের।
খানিক বাদেই এই পথেই অর্জুনের সাথে দেখা এক সাঁওতালি মেয়ের। কথার ফাঁকে মেয়ে বলে আমায় সকলে মেঝেন বুলেই ডাক পাড়ে। তুমিও তাই বোলো। হ্যাঁ গা ,তুমার বড়ই বড়াই শুনছি পথঘাটে। কানপাতায় দায় হৈছে ,তুমি বুলি আওড়াইছ ,তুমিই আর্য যার সকলই অনার্য।
শুনো তবে একখান বচন আমার ,এই মেঝেনের কৃষ্ণবরণ ,এর রূপ দেখে কবি গানই বাঁধলেন কৃষ্ণকলি। আবার তুমাকে লিয়েও নাটক বাঁধলেন। তুমার কত গুণ গান গাইলেন। এইবিটিনি আমার যা জ্ঞান গম্যি তাতে কবি বলেছেন তুমি আর আমি সুমান সুমান। কেও ছোটও লই কেও বড়োও লই।
মেঝেন বলেই চলেছে কথা ,অর্জুন মুগ্ধ হয়ে শুনছে। যেমন ধরো রাধাচূড়া আর পলাশ ,পারুল  তুমার লেগে রঙীন পথ কেটেছে। পথিক হাঁটতে লাগে যখুন ওঁদের পায়ে নূপুরের শব্দ হয়। ওরাও মজা পায়। পারুল আর রাধাচূড়ার  কত সুনাম করে লোকজনে । আর কি যেন বলে ,কন্ট্রাস্ট কালার না কি। পারুল আর রাধাচূড়ার বরণ দেখে ওই শহর থেকে যারা আসে ওরাই বলাবলি করে।  অত বুঝিনা তবে খুশী হয় এটা জানি।
তুমায় দেখার আগেই অলক্ষ্য রং লাগাই আকাশের গায়ে শিমুল ,পলাশ ,অশোক, কৃষ্ণচূড়া  ,রাধাচূড়া ,পারুল। পথিক সেই রঙে রঙিন হয়ে তোমার দ্বারে এসে দাঁড়ায়।
তুমি যখন বাকল ছাড়ো কি কদাকার লাগে ,তুমি জানো। কিন্তু এই পলাশ থেকে পারুল তোমার এই রূপকে ঢেকে দেয় তাদের রংয়ে।এই মেঝেনের কথায় একবার নিচে দেখো মাটির ওপর রঙের পথ আর একবার আকাশ পানে দেখো কেমন রঙীন আলো।
এই বলেই মেঝেন কখন  পলাইছে টের পাইনি অর্জুন। অর্জুন তো পলাশ থেকে পারুলের রূপে মুগ্ধ। এক ঘোরেই আছে। ডাক পাড়ে," মেঝেন  ও মেঝেন আরও বল কতকি জানিনা ,নিজের অহংয়ে আমি অন্ধ। তোমার জ্ঞানের রূপে আমি মুগ্ধ। আরও একটু বোস। দাও তোমার ব্যক্তিত্বের শীতল ছোঁয়া। আকণ্ঠ পান করি। "....
---------
 ওযে  চলে যাওয়ার সময় বলে গেল না। বাস্তবে ফিরেছে অর্জুন।মন খারাপ ওর চলে যাওয়াতে। এতদিন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। ঘাড় বাঁকিয়ে দেখা হয়নি প্রকৃতির রূপ। নেওয়া হয়নি রস ,গন্ধ।
অর্জুন ,পলাশ ,শিমুল ,অশোকরাও তো পুরুষ। ওদের তো কোনো বড়াই নেই। প্রতি বছর বসন্তের আশায় থাকে। নিজেদের পরিবর্তন করে ,যত্ন করে যাতে ফি বছর রঙে রঙে রঙীন হয়ে ওঠে। রাধাচূড়া ,পারুল কেও ওদের মতো থাকতেও দেয়।
আচ্ছা আমি কেন ভাবি সুখটা শুধুই আমার ,কষ্টটা ওদের। আজ বসন্ত আর কৃষ্ণকলি আমার চোখ খুলে দিয়েছে।
-------------
আমার মা না থাকলে আমার জন্মই হতো না। কে চিনত আমায়। পারুলরা না থাকলে আমার কাছে কেউ আসতো না। পথে পথে সুন্দর সজ্জার শয্যা কে পেতে রাখতো। আকাশের দিকে কে চেয়ে দেখতো পলাশরা না থাকলে।
মা আমার জন্ম দিয়েছে আর ওই মেয়ে ,কৃষ্ণকলি আমার জ্ঞান চোখে সাম্যের কাজল পড়িয়েছে। এরা সকলেই নারী। নাড়ির সংযোগ এই নারীর সাথে। মিছে অহমিকা আমার। মা।,মেয়ে ,ভাৰ্য্যা সকলই তো একজন। সে কে ?ও কে ?
মা কে ?সকলেই নারী। এই আকাশের অর্ধেক নারী আর অর্ধেক পুরুষ। ভাগের চিহ্নও চোখে পড়েনা। ভালোবাসা থেকে ভালোলাগার হেতু তুমি নারী। কেও আর্য ,অনার্য নয়। সকলই সমান।
এই শিক্ষা দিলো নাম না জানা মেয়ে। ও আমার পরম প্রাপ্তি ,ভালোবাসা আমার। জীবন এতো সুন্দর সে তুমি বোঝালে নারী। আর অহং নেই গো আমার। এসো নারী ,পুরুষ সকলে আমাদের জীবন উৎসব পালন করি। তুমি ছাড়া এ আকাশ অপূর্ণ। তুমি ?তুমি আমার অর্ধেক আকাশ। .......

















Friday 2 March 2018

যে জন আমার মনে 
#মৌসুমী রায়
শেষ পর্ব

তোয়ার কাছে  ওর বাবা , বন্ধু ,শিক্ষক ,সুখদুঃখের সাথী। কষ্ট হলে বাবার সাথে কথা বলে ,মন খারাপে বাবার কাছে কাঁদে। বাবা অজানা প্রশ্নের উত্তরের অভিধান। 
পয়া ছোটতে যে প্রকাশ গুলো করত সেগুলো সমৃদ্ধার মধ্যে নতুন করে খুঁজে পেত্। সমৃদ্ধা বেশ বড় হয়েছে। ও, ওর লেখাপড়ার জগৎ ,গান ,নাচ ,কবিতা নিয়ে ব্যস্ত। তোয়াও নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। মন কেমনের জায়গা একটু কম রেখেছে। ইদানিং সু কে যেন অন্যরকম ঠেকছে। আগে কক্ষনও এমন দেখেনি। আশাও করেনি পরিবর্তনের। তোয়া পরিবর্তনে বিশ্বাস করেনা। মানুষ তার নিজস্বতা নিয়ে বাঁচবে। অনুকরণ আর  হুবহু  অনুসরণের পরিপন্থী। সে যাই হোক। বয়সের ভারে সু ন্যুব্জ। কিন্তু তাঁর সৌন্দর্য  অটুট। সু চায় তোয়া ওকে মা বোলে ডাকুক। চোখের সামনে সমৃদ্ধা তোয়াকে মা ডাকে। কান যেন আরাম পায়। মা ডাকতে না দিয়ে তোয়াকে পৃথিবীর বিশাল সুখ থেকে বঞ্চিত করেছে। 

অর্থের প্রাচুর্য আছে কিন্তু সু আজ স্নেহ ,ভালোবাসার কাঙাল। কেমন যেন বাচ্চাদের মত। সমৃদ্ধা কে আদর করলে ওর ও আদর পেতে ইচ্ছে করে তোয়ার কাছে। অহংকারে তোয়ার ছোট থেকে বড় হওয়ার মুখ দেখা হয়ে ওঠেনি। সমৃদ্ধার বড় হওয়া সু দেখছে। ভাবছে তোয়াও তো এমন ছিল। অবসর তখন ছিল না ,এখন অনন্ত ,অখন্ড অবসর।
সমৃদ্ধা ওঁকে দিম্মা বলে। নাতনিকে খুব স্নেহ করেন। ওর বায়না ,আবদার সব সামলান দিম্মা। ওঁর ইচ্ছে সমৃদ্ধার জন্মদিন এ  এবার আড়ম্বর হবে। বন্ধু ,বান্ধব আসবে। তারমধ্যে বিশেষ বন্ধুকে সু পরখ করতে চায়। সে যেন মানুষ হয়। তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকে উপলব্ধি। শুদ্ধসত্য যেমন ,ঠিক তেমন যদি নাতনির জীবন সঙ্গী হয় তাহলে বেশ হয়। নিজের মনে নিজেই বলে। বাইরে বলতে ইচ্ছে থাকলেও বলতে পারেনা। সাহস নেই সত্যের মুখোমুখি হওয়া।

জন্মদিনে খুব আনন্দ ,মজা হল। মিনতির আজ খুব পরিশ্রম হয়েছে। ওর ও বয়স হয়েছে। এই বাড়িতে ওর মায়া পড়ে গিয়েছে। ইচ্ছে এদের সাথে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। সমৃদ্ধা ওকে ছাড়তে চায়না। মিনতি ঘুমিয়ে পড়েছে। সমৃদ্ধাও নিজের ঘরে।সু ওষুধ খায় নানান অসুখের আর ঘুমের ওষুধ  ও খায়। আজ তোয়া দিলে সেটা সরিয়ে রাখে। বলে "আজ একটু আমার পাশে বোস তোয়া ,অনেক কথা আছে ;আজ সব বলব ,না বললে কোনদিন আর বলতে পারবনা "...
তোয়ার চোখ এ ঘুম এসেছে ,তবুও সে শুনতে চাই ওঁর কথা।
সু তোয়ার মাথাটা নিজের কোলে টেনে নেয়। চুলে আঙুল দিয়ে আদর করছে। তোয়ার নতুন কোরে সু কে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে ,মা বলতে মন চাইছে। এতো বড় হয়েছে ওঁর কাছে মায়ের আদর এই প্রথম।
"জানিস তোয়া ,অহংকার আমায় সন্তান ও স্বামী সুখ থেকে বঞ্চিত করেছে।পয়াকে খুব মনে মনে মিস করি। ও আমার অবহেলার শিকার। শুদ্ধসত্যর চলে যাওয়া চোখে পোটি বাঁধার অভিনয়। ওঁ তো যায়নি ,আমি ওকে চলেযেতে বাধ্য করেছিলাম।  ওঁর খাবারে  বিষক্রিয়ায় আমিই দায়ী। তুই যে শীর্ষ কে ভালো বাসতিস সে আমার অজানা ছিল না। অজানা নয় শীর্ষর তোর প্রতি ভালোবাসা। আভিজাত্যের মোহে ,অর্থের মোহে অন্ধ ছিলাম। পাছে শীর্ষর সাথে বিয়ে হলে আমার আভিজাত্যে ঘুণ ধরে। ওদের অনেক টাকাপয়সা দিয়ে এই বাংলা ছেড়ে অন্যত্র পাঠিয়ে ছিলাম। জানিনা কেমন আছে। তোর বিয়ে একটা মানসিক অসুষ্থ ছেলের সাথে দেওয়া আভিজাত্যের বড়াইয়ের আর অর্থের লোভে। তোর মত গুণের মেয়ের সর্বনাশ এর হাতেই। নিজের স্বামীর ভালোবাসা ছেড়ে পরের ভালোবাসায় ভাগবসিয়ে ছিলাম। ঈশ্বর তার ঠিক বিচার করেছেন আমার প্রতি। অন্যায় টা তো অন্যায়। যখন বোধগম্য হোল তখন সবশেষ।
এখন আমি তোর মা ডাক শুনে যেতে চাই তোয়া। একবার মা বলে ডাক। তোয়া কঠোর হতে পারল না। মায়ের কান্না এই বয়সে সহন হয়নি। মা বলে আর অঝোরে কাঁদে। তোয়াকে মা আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। একটা আবদার রাখবি ?,
  যে ছেলেটি সমৃদ্ধার খুব কাছের বন্ধু ও আমার খুব পছন্দের। ওর মধ্যে আমি শীর্ষ কে খুঁজে পেলাম। তুই শুধু মত দে। "...
শুনতে শুনতে মা ,মেয়ে চোখের জলে ধুয়ে যাচ্ছে। সমৃদ্ধার ওকে পছন্দ তোয়া জানে। ওদের বিয়েতেও তোয়া মত দিয়েছে  আগেই। সু অমত করলেও এই বিয়ে হতই। মায়ের ডাকে  তোয়া "মা "...বোলে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে  কান্নায়  ভেঙে পড়েছে। ভোর হয়ে গিয়েছে ,বাইরে পাখিদের কলকাকলি। বারান্দায় আজকে হাওয়াটা খুব মিষ্টি লাগছে তোয়ার।   এই শতাব্দীর নতুন সকালের নতুন সূর্যের কিরণে মা মেয়ে নতুন স্নান সেরেছে।কত কাজকম্ম বাকি। আজ একটু তাড়াতাড়ি হাত চালাতে হবে।