Sunday 28 January 2018

দুই বিনুনী 
#মৌসুমী রায় 
এই সেদিনের মেয়ে ,আজ বয়স বারো  হলো। সরস্বতী পুজোয় ওর নাচের অনুষ্ঠান  হবে বাড়িতে এবং স্কুলে ,সাথে গান ও গাইবে মেয়েটি । তোড়জোড় শুরু ,পুজোর  সামগ্রীর সাথে সাথে ঠাকুর আসবে বাড়িতে। সেই ছোট্ট মেয়ে আজ শাড়ি পড়বে। বসন্ত পঞ্চমীর  শুক্ল পক্ষে, আদরের বাড়ির ছোট্ট সরস্বতী। বাসন্তী রঙে লাল পেড়ে শাড়ি ,কপালে সাদা রঙের  কলকা এঁকে গোল টিপ্ লাল রঙের  আর তার সাথে দুই বিনুনি খেজুর ছড়ি শৈলীতে বাঁধা। সেটিকে বেড়া বিনুনী বেঁধে পলাশ  মালা জড়ানো থাকবে। কানে পলাশের দুল ,হাতে পলাশের বালা ,আর নাকে পলাশের বেসর এবং গলায় পলাশের মালিকা। বাজু বন্ধনী আর কোমর বন্ধনীও পলাশ মালিকায়।  এই বেশ ভূষণ  সজ্জা  পরিকল্পনা মেয়েটির দাদুর। আর কপালে টিকলি থাকবে ,সেটাও ওই পলাশের। 

কয়েক দিন ধরেই চলছে রিহার্সাল বাড়িতে। মধুর মধুর ধ্বনি আর আজি কমল মুকুল দল খুলিলো  গানের সাথে নাচ  অনুশীলন। মাঝে মাঝে দাদু নাতনিকে নাচের ভঙ্গিমাও দেখাচ্ছেন। কমল মুকুল দল খুলিল গানের কথায় দুটি হাত ঘুরিয়ে প্রথমে কুঁড়ি মুদ্রায় এনে ফুটিয়ে তোলার মুদ্রা আনতে হবে।মধুর মধুর ধ্বনিতে বীণা বাদন ভঙ্গীতে নৃত্য প্রদর্শন।   বলে রাখি দাদু নাচের কিছুই জানেন না। কিন্তু রবি ঠাকুর তাঁর প্রিয়। সুতরাং নাচটাও তাঁর মনে হয় নাতনী এই ভাবে নাচলে বুঝি সুন্দর প্রদর্শন হবে। প্রায় ঘন্টা খানেক নাচের অভ্যাস চলত। আর গান এর অভ্যাস  ও চলত ঘন্টা খানেক। সঙ্গত করতো মেয়েটির কাকা। তিনি ভালো তবলা বাজাতেন। লোকে মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে শুনতো। আরও একটি গুণ তাঁর অপূর্ব যাত্রাভিনয়। মঞ্চে উঠলে সবাই তাঁকেই দেখতেন। যেমন তাঁর বাচন ভঙ্গী তেমন স্পষ্ট উচ্চারণ। হ্যাঁ ,ওইযে বলছিলাম গানের সঙ্গত করার সময় কাকার তবলার বোলে শেষ তেহাই টা আজও মেয়েটার স্মৃতিতে। মেয়েটি তাঁর দাদু এবং কাকার তালিমে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে।  এভাবেই অনুশীলন চলত। থেকে থেকে আনন্দে বলতেন দাদু ,আসলের চেয়ে সুদ মিষ্টি একেই বলে বুঝলে নাতনী। তুমি আমার সংসারে হঠাৎ ভেসে আসা ধন নও ,তুমি আমার অন্তরের অন্তহীন ভালোবাসার ধন। বলেই একটা চারমিনার সিগারেট ধরাতেন ,আর সুখটান দিতেন। একেবারে সিগারেটের শেষ টান অব্দি টানতেন। বাম হাতের মধ্যমা আর তর্জনী উপরের কর দুটি তামাক রঙে রাঙানো।
দাদুর একটা বেগুন ,এই সিগারেট পান করা। বাড়ির নিষেধ শুনতেন না। ছোট্ট নাতনী তখন জানত না এটা ভাল নয় শরীরের পক্ষে।  

মাস খানেক ধরে চলত কঠোর অনুশীলন ,গলার জন্য চলত কসরত। গার্গেল করা ,নীচু স্কেল এ ওম উচ্চারণ আর গলা সাধা।  আচার বা টক জাতীয় কিছু খাওয়া যাবেনা। ঠান্ডা লাগানো যাবেনা ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেকে এই নিয়ে হাসাহাসি করত আড়ালে। মাঝে মাঝে এ ভাবেই চলত  দাদুর দেখভাল আর পরামর্শ। রবিঠাকুরের গানের সঞ্চারী তে নৃত্যের ভঙ্গিমা কেমন হবে। সঞ্চারী কিন্তু গানের মর্ম কথা ও সুরের অপূর্ব মেল্ বন্ধন ,নাচ টা সেই ভাবে পরিবেশন করতে হবে। মাঝে মধ্যে চলছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি। অন্য সদস্যদের পরিবেশন। সেখানেও দাদুর অনুশীলন। কোথায় কোথায় গলার ওঠা নামা ,গম্ভীর এবং স্পষ্ট উচ্চারণ।
থেকে থেকে সাজসজ্জার কথা উঠলেই বার কয়েক নাতনীর দুই বিনুনী আর পলাশের মালার পুনরাবৃত্তি।এর আয়োজনে ত্রুটি না হয়। হলেই কেলেঙ্কারি ,একেবারে যাকে বলে দক্ষ যজ্ঞ।

পরিবারে কর্তার আনন্দ আর সদস্যদের আনন্দের যৌথ কলস পূর্ণতা লাভ করলো। আনন্দ ধ্বনির প্রতিধ্বনিতে উপচিয়ে পড়ছে খুশী। খুশী গুলী কত আল্পনায় পথ এঁকেছে। গন্ধের ম ম ,বসন্তের বাতাসের মত বইছে। আজকের মতো খুশী দাদুকে কখনও দেখেনি বাড়ির সদস্যরা। আজ সত্তরের দাদু যেন সাতাশের প্রাণোচ্ছল যুবক। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা ,শীতল ষষ্ঠীর কলায় সেদ্ধ ,সব মিলিয়ে এক উৎসব বটে।
স্কুলের অনুষ্ঠান পুজোর দিন। সেদিনের দুই বিনুনী বাঁধা ,ফুলের সাজ সেটাও দাদুর দেখভালে। ওই অনুষ্ঠানে সকলে খুব খুশী। তার সাথে প্রশংসা চুলের প্রসাধনের। পরের দিন বাড়িতে অনুষ্ঠান ,অনেকে উপস্থিত। সকল সদস্যদের অনুষ্ঠান পরিবেশন এবং তাঁর প্রিয় নাতনীর নৃত্যানুষ্ঠান।বিনুনী মেয়েটির মা যত্নে বেঁধে ছেন। ছোট্ট পায়ে আলতা পড়েছে। হাতেও আলতার আঁকিবুকি। বেশ লাগছে মেয়েটিকে। একেবারে বিয়েতে কনের সাজে। ঠাকুমা ,মা ,কাকীমা কনিষ্ঠা র নখে দাঁত ঠেকিয়ে কি সব করল। নজর না লাগে।
দুই বিনুনী খুব শক্ত ভাবে বন্ধনে আবদ্ধ ;আর ফুলের মালারও অটুট বন্ধন। দাদু খুশী। নাতনী তাঁর মনের মত অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছে।
অনুষ্ঠান শেষে দাদু কিছু কথা পরিবেশন করেন। তিনি বলেন ,"দেখা না দেখার মাঝে কতই স্মৃতি সুধা ,আজকে নগদ কালকে ধারের সুখের সুতোয় বাঁধা। বারে বারে বাঁধব তোমায় জনম জনম ধরে ,হাসি খুশী থেকো সবাই শুধুই যোগের ঘরে। থাকবনা যখন আমি দেখবে নতুন সূর্য নতুন ভোর ,এই আশাতেই ভরুক ভাবনা মোর। ভালোবেসো সকল জনে মনে প্রাণে ,কর্মে মৃত্যুঞ্জয়ী হোক তোমার আমার ভালোবাসার টানে ".....
বলেই দাদু  চোখ দুটি অঝোরে বইতে লাগল অশ্রু নদী। স্তব্ধ সবাই কেও করতালি দিতে গিয়েও পারলনা।
ধাতস্থ হয়ে দাদু আবার বলে গেলেন তাঁর বাড়ির এতো দিনের পরিশ্রমের কথা। আর বললেন এই দুই বিনুনী বাঁধা নাতনীর কথা। অনেক দিনের সাধ ছিল বাড়িতে এক কন্যা সন্তানের আগমন। নাতনী সেই বাসনা পূর্ণ করেছে।
এক প্রত্যন্ত গ্রামের দাদু নাতনীর যুগলবন্দী গ্রামবাসীদের আনন্দ দিয়ে ছিল সেইদিন। মন্ত্র মুগ্দ্ধ অনুষ্ঠানের পর সকল গ্রামবাসীর মুখে মুখে ধ্বনিত , পরিবারে মেয়েদের সৌন্দর্য  ই আলাদা। মনে মনে প্রত্যেক পরিবার দুই বিনুনী বাঁধা মেয়েটির শুভ কামনার সাথে তাঁদের পরিবারে কন্যা সন্তানের আগমনের কামনা ও জানিয়েছিল। 

  

Tuesday 9 January 2018

নববর্ষ 
#মৌসুমী রায় 
পদ্মাসনে স্বাগত নববর্ষ ,তুমি তোমার তরঙ্গ কল কল্লোলে। 
ক্ষুদ্র চাওয়া পাওয়ার উর্দ্ধে আজ সকল হৃদয় দোদুল দোলে।।

বছর ভরে ,স্তরে স্তরে আশা আকাঙ্খায় যতনে সাজানো ঝাঁপি। 
বে -হিসেবি ,পূর্ণ -অপূর্ণের ডালি অংকে রাখেনি মাপি।।

এস বন্ধু হয়ে ,নম্র বয়ানে আমার নত নয়নের কোলে পৃথিবী পরে। 
যা কিছু হারিয়েছি জানি সে পূর্ণ হবেনা এ ভবের সংসারে।। 

তবুও হে অনন্ত নিখিল তোমার ভালোবাসা রাখার আধার অফুরন্ত। 
দুখের মাঝেও চিনি যেন তোমার সুখের  বিশালতার  অনন্ত।। 

হে সুন্দর নিয়ত নব রূপে এস মনের কোণের হৃদয় আসনে। 
দিন রাত্রি যাপন করি নববর্ষ রূপে দেহে লালনে  মনে যতনে।।   

সময় হয়েছে মানবজাতির নববর্ষ কে বাঁধতে নতুন অঙ্গীকারে। 
শত অবাঞ্ছিতের মাঝেও আমরা দিয়ে যাব  নবীন বসতি আগামীরে।।  

Thursday 4 January 2018

পৌষাললো 
#মৌসুমী রায়
বীরভূমের মেয়ে হওয়ার সুবাদে  বীরভূমের অনেক টুকরো স্মৃতি আজও স্মৃতিপটে। বোধকরি শীতের স্মৃতি একটু বেশিই টাটকা। আমাদের গ্রামের বাড়ি একান্নবর্তী। শীতের ছুটিতে খুড়তুতো ,পিসতুতো ভাইবোনদের সমাগম। আমার বাবা বড় ছিলেন তাই জেঠতুতো কেও ছিল না। শীতের আমেজে এমনই টাটকা হতাম যে বিদ্যালয়ের ছুটি পেরিয়ে গেলেও কোনো হেলদোল থাকত না। যে এবারে শহরে ফিরতে হবে ,আবার নতুন ভাবে সব শুরু করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ফেরার সময় দাদু ,ঠাকুমা ,বড়মার জন্য মন খারাপ  করত। ও হ্যাঁ বড়মা আমার দাদুর মা। ফেরার দিন গরুর গাড়িতে করে বাস স্ট্যান্ড আসতে হত তখন। ফিরে  আসার দিন দাদু সদর দরজায় চুপ করে বসে থাকতেন। অন্য দিনের মতো হাঁক ডাক নেই তাঁর। বড়মা আমাদের বাড়ির আমতলায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন। গরুর গাড়িতে যাওয়ার সময় গাড়িথেকে যতদূর দেখাযায় সে আমার ঠাকুমার চোখের জলে ভেজা মুখখানা। খুব মন খারাপ আমাদেরও। আরও মনে আছে গ্রামের বাড়িথেকে যে জামাকাপড় গুলো আনতাম তার গন্ধ শুঁকতাম। আর বাড়ির গন্ধ পেতাম। 

হ্যাঁ ওই যে বলছিলাম শীতের কথা। সে বেশ লাগত জানো। ভোরের সূর্য আলো দেওয়ার আগে আমাদের বাড়ির কাজ করত গোবর্ধন কাকা মাটির হাঁড়িতে করে ধোঁয়া ওঠা খেজুরের রস নিয়ে আসত। আশ মিটিয়ে খাওয়া হত। যতদিন শীতের ছুটি ততদিন ওই খেজুর রস। আহা কি মিষ্টি ,কি সুস্বাদু কি বলব। 
খানিক বাদে রোদ উঠতেই কাঠের উনুনের আঙ্গারে কালো কালো বেগুন পুড়িয়ে ভালো করে সর্ষের তেল ,কাঁচালঙ্কা ,পেঁয়াজ দিয়ে মেখে বেগুনপোড়া আর মুড়ি খাওয়া। তখন জল খাবারে রুটি ভাবাই যেতনা।
তার উপর পিঠে ,পুলি তো ছিলই। সেই পিঠের চাল গুঁড়ো হত ঢেঁকিতে।ঢেঁকি পাড় দেওয়াও যেন কি মজার। আর একজন ঢেঁকির পাড়ের তালেতালে চালগুলোকে ইস্পাতের পাত দিয়ে ঘেরা গর্তে  হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওলট পালট করতেন। সেও এক শিল্প না দেখলে বোঝা যাবেনা। তালে তালে হাত না ঘোরালে   হাত কেটে একেবারে ফালাফালা হয়ে যাবে। ঢেঁকি পাড়ের সাথে সাথে চলত বীরভূমের মাটির গান।

এছাড়াও আরও একটি শীতের আনন্দ পৌষাললো। পৌষ মাসের বনভোজন। পৌষের মিঠে কড়া রোদ মেখে নতুন ধানের চালের ভাত ,শীতের সবজি আর হাঁসের ডিমের ঝোল খাওয়া। বাড়িথেকেই সব জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে গ্রামের শেষ প্রান্তে কেটে নেওয়া ধানক্ষেতে রান্না বান্না করা হতো । আর হ্যাঁ রান্না করার পূর্বে যে উনুন তৈরী হতো তার পাশেই মাটিদিয়ে একটা লাফিং বুদ্ধর মত দেখতে মূর্তি গড়া হতো। সেটি আসলে ভৈরব মূর্তি। আগুন জ্বালানোর পূর্বে আনাজপাতি সব উৎসর্গ করা হতো। নির্বিঘ্নে পৌষাললো সম্পন্ন করার তাগিদে। কোনও জৌলুস ছিলোনা। ছিল মনের তৃপ্তি। সূর্য ডোবার পূর্বে বাড়ি ফেরা। আজকের দিনে গ্রামের বাড়ির স্মৃতি হাতড়ে মরি। হাজার বার চাইলেও ফিরে পাবনা সেই দিনের শীতের আনন্দের অনুভূতি।