Thursday 4 January 2018

পৌষাললো 
#মৌসুমী রায়
বীরভূমের মেয়ে হওয়ার সুবাদে  বীরভূমের অনেক টুকরো স্মৃতি আজও স্মৃতিপটে। বোধকরি শীতের স্মৃতি একটু বেশিই টাটকা। আমাদের গ্রামের বাড়ি একান্নবর্তী। শীতের ছুটিতে খুড়তুতো ,পিসতুতো ভাইবোনদের সমাগম। আমার বাবা বড় ছিলেন তাই জেঠতুতো কেও ছিল না। শীতের আমেজে এমনই টাটকা হতাম যে বিদ্যালয়ের ছুটি পেরিয়ে গেলেও কোনো হেলদোল থাকত না। যে এবারে শহরে ফিরতে হবে ,আবার নতুন ভাবে সব শুরু করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ফেরার সময় দাদু ,ঠাকুমা ,বড়মার জন্য মন খারাপ  করত। ও হ্যাঁ বড়মা আমার দাদুর মা। ফেরার দিন গরুর গাড়িতে করে বাস স্ট্যান্ড আসতে হত তখন। ফিরে  আসার দিন দাদু সদর দরজায় চুপ করে বসে থাকতেন। অন্য দিনের মতো হাঁক ডাক নেই তাঁর। বড়মা আমাদের বাড়ির আমতলায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন। গরুর গাড়িতে যাওয়ার সময় গাড়িথেকে যতদূর দেখাযায় সে আমার ঠাকুমার চোখের জলে ভেজা মুখখানা। খুব মন খারাপ আমাদেরও। আরও মনে আছে গ্রামের বাড়িথেকে যে জামাকাপড় গুলো আনতাম তার গন্ধ শুঁকতাম। আর বাড়ির গন্ধ পেতাম। 

হ্যাঁ ওই যে বলছিলাম শীতের কথা। সে বেশ লাগত জানো। ভোরের সূর্য আলো দেওয়ার আগে আমাদের বাড়ির কাজ করত গোবর্ধন কাকা মাটির হাঁড়িতে করে ধোঁয়া ওঠা খেজুরের রস নিয়ে আসত। আশ মিটিয়ে খাওয়া হত। যতদিন শীতের ছুটি ততদিন ওই খেজুর রস। আহা কি মিষ্টি ,কি সুস্বাদু কি বলব। 
খানিক বাদে রোদ উঠতেই কাঠের উনুনের আঙ্গারে কালো কালো বেগুন পুড়িয়ে ভালো করে সর্ষের তেল ,কাঁচালঙ্কা ,পেঁয়াজ দিয়ে মেখে বেগুনপোড়া আর মুড়ি খাওয়া। তখন জল খাবারে রুটি ভাবাই যেতনা।
তার উপর পিঠে ,পুলি তো ছিলই। সেই পিঠের চাল গুঁড়ো হত ঢেঁকিতে।ঢেঁকি পাড় দেওয়াও যেন কি মজার। আর একজন ঢেঁকির পাড়ের তালেতালে চালগুলোকে ইস্পাতের পাত দিয়ে ঘেরা গর্তে  হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওলট পালট করতেন। সেও এক শিল্প না দেখলে বোঝা যাবেনা। তালে তালে হাত না ঘোরালে   হাত কেটে একেবারে ফালাফালা হয়ে যাবে। ঢেঁকি পাড়ের সাথে সাথে চলত বীরভূমের মাটির গান।

এছাড়াও আরও একটি শীতের আনন্দ পৌষাললো। পৌষ মাসের বনভোজন। পৌষের মিঠে কড়া রোদ মেখে নতুন ধানের চালের ভাত ,শীতের সবজি আর হাঁসের ডিমের ঝোল খাওয়া। বাড়িথেকেই সব জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে গ্রামের শেষ প্রান্তে কেটে নেওয়া ধানক্ষেতে রান্না বান্না করা হতো । আর হ্যাঁ রান্না করার পূর্বে যে উনুন তৈরী হতো তার পাশেই মাটিদিয়ে একটা লাফিং বুদ্ধর মত দেখতে মূর্তি গড়া হতো। সেটি আসলে ভৈরব মূর্তি। আগুন জ্বালানোর পূর্বে আনাজপাতি সব উৎসর্গ করা হতো। নির্বিঘ্নে পৌষাললো সম্পন্ন করার তাগিদে। কোনও জৌলুস ছিলোনা। ছিল মনের তৃপ্তি। সূর্য ডোবার পূর্বে বাড়ি ফেরা। আজকের দিনে গ্রামের বাড়ির স্মৃতি হাতড়ে মরি। হাজার বার চাইলেও ফিরে পাবনা সেই দিনের শীতের আনন্দের অনুভূতি। 

  

No comments:

Post a Comment