Wednesday 18 October 2017

পূর্ণিমা 
# মৌসুমী রায় 
বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম  এ ভুজঙ্গ ভূষণ সেন শর্মার নিজ গৃহে কালী পূজার প্রস্তুতি চলত দুর্গাপুজোর দশমীর পরের দিন থেকে। কারণ পুকুর ঘাট থেকে এঁটেল মাটি তুলে এনে শখানেক প্রদীপ গড়তে হত ,শুকোতে দিতে হতো , এমনকি আগুনে পুড়িয়ে একেবারে শক্ত পোক্ত করে একটা বাঁশের ছিলা দিয়ে বানানো ঝুড়ি তে ভরে চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরে এককোনে রেখে দেওয়াহত ,বাচ্চাদের নাগালের বাইরে।  প্রদীপের সর্ষের    তেল থেকে সলতে সব কিছুই বাড়ির তৈরী  ; জমির সর্ষে পিষিয়ে তেল হত ,বাড়িতে কার্পাস তুলোর গাছ আবার শিমুল তুলোরও। কাপাস তুলোর সলতে পাকানো হতো । গিন্নিমারা  দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে ছালের কাপড়পড়ে সলতে পাকাতেন। সে এক ধুম বটে বাড়িতে। ওই সব দেখতে গিয়ে পড়াশোনা মাথায় উঠতো আরকি। পড়তেও হত পুজোর ছুটির পরে পরে ক্লাসে ওঠার পরীক্ষা। কি রাগ হতো কী বলব। সব রাগ পড়ত ওই বিদ্যা সাগর মহাশয়ের ওপর। 

সমস্ত কাজ নিপুণহাতে সম্পন্ন করত ওই বাড়ির পরিচারিকা সুষমা মুর্মু আর ওর মেয়ে পুন্নুমা ছাড়াও আরও একজন ওই বাড়ির মেয়ে শ্রমণার ছোটবেলার বন্ধু শামীম। পুন্নুমার নাম পূর্ণিমা কিন্তু ওর বাড়ির সবাই পুন্নিমা আর পুন্নুমা বলেই ডাকত ,  এবাড়ির সকলে পূর্ণিমা বলে। পূর্ণিমার গায়ের রং শ্যামলা ,চোখদুটো উজ্বল সবসময় যেন কথা বলে ;আর নাক টা চাপা হলেও ওকে কৃষ্ণকলি অনায়াসে বলা যাই ;সুষমা পিসির তাতে সাই নেই ,সুতরাং ওকে পুন্নুমা ডাকতে হবে। আর শামীম ? শ্রমণা দের   গাঁয়ের ,পাশের গাঁয়ে থাকে ,ছোটবেলা থেকে এবাড়িতে ওর আব্বু হাকিম শেখের সাথে আসত ,সেইথেকে শ্রমণারা তিন বন্ধু। হাকিম চাচা আবার ভুশুনসেনের সর্বক্ষণের বিশ্বস্ত সঙ্গী। ভুজঙ্গ ভূষণ কে সকলে ভুশুনসেন নামেই ডাকতেন ,ও হ্যাঁ সেন মহাশয় তাঁর নামে ধারে ভারে কাটেন ;তিনি যা বলবেন তাই হবে এই কথা সকলের জানা। 

 প্রথম প্রথম বাড়ির গিন্নিমার  ছোঁয়াছুঁয়ি ,এটা ধরবেনা ,ওটা নাড়বেনা গোছের শুচি বায়ু চাগাড় দিত। এমনকী কলাইকরা সানকি থালায় ওঁদের খেতে দিতেন ,সিমেন্ট বাঁধানো মেঝের এঁটো শুকরি গোবর দিয়ে ধুতে বলতেন ;বাড়ির খিড়কি দরজা থেকে সদর সমস্ত টা ই গোবর জলের লেপন থাকত। পাকা বাড়ির সর্বত্র গোবর এর গন্ধে তিষ্ঠোনো যেতনা।  সেন  বাড়িতে কত লোকজন আসতেন , প্রথম অভ্যর্থনা হতো এক কাঁসার ডিস্ এ গুড়ের বাতাসা আর কাঁসার ঘটিতে জল ; কাঁসার গেলাসে ও  জল টলটল করত, এমনকি গেলাসটি এমন চকচক করতো যে মুখ দেখা যেত। তাহলে হবে কি একচুমুক দিলেই গোবর গোবর গন্ধ। লোকজন বাতাসা খেয়েই তুষ্ট হতেন তেষ্টায় ছাতি ফাটলেও জলমুখো হতেননা। 
এসব ভুশুনসেনের নজর এড়াতনা , তাই গোয়ালঘরের গোবর ওই গোয়াল পর্যন্ত রইল ,বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ নিষিদ্ধ হল।
কালীপুজোর আগে যখন শ্রমণারা তিনবন্ধু ছোটছিল তখন সুষমা পিসি সব করত। মানে প্রদীপ তৈরী করা থেকে শুকানো ,শুকনো প্রদীপ চিলেকোঠা থেকে নামানো। সব পরিশ্রমের কাজ সুষমা পিসির ,আর গিন্নিমাদের কাজ  সেই প্রদীপ জ্বালিয়ে মন্দিরে মন্দিরে দেওয়া ,খিড়কি থেকে সদর পর্যন্ত  পুত্র বধূরা সাজাতেন। প্রদীপ জ্বালানোতে সুষমার ছোঁয়া অশুচি হবে। 
এমনই এক কালীপুজোর আগের রাত্রে ভূতচতুর্দশী তে পুর্ণিমা বলে  দাদামশাই,এ কেমন রীতি গো তোমাদের ;আমরা সাঁওতাল বটি ,নীচু জাত কিন্তু চোদ্দ শাক তুলে আনি ,প্রদীপ গড়ি ,তোমাদের খাবার জল আনি। কিন্তু মন্দিরে উঠে দীপাবলির দিনে দীপ জ্বালাতে পারিনা। কেননা আমরা নীচু জাত। আবার শামীম দিদি , আমি  শ্রমণা দিদি একসাথে খেলাকরি ,স্কুলে যাই সেখানে স্যার ,দিদিমণিরা তফাৎ পড়ান না। তাহলে শামীমদিদি ,আমি ,আমার মা কেন দীপ জ্বালাবোনা বলতে পারো ? অঝোরে পূর্ণিমার দুই গাল অশ্রুধারায় সিক্ত ,সিক্ত ঠোঁট দুটি প্রতিবাদের ভাষায় কাঁপছে। 
আজ প্রতিবাদ ভাষার সার্থক জন্ম লাভ করেছে ,সবাই স্তব্ধ সুঁচ পড়লে তার শব্দ ও যেন অনুরণন সৃষ্টি করবে। 

এখনও থামেনি পূর্ণিমা বলেই চলেছে অবহেলা ,অনুকম্পা ,অশ্রদ্ধার ,বঞ্চনার কথা। 
মাকালী ?সেওতো এক মেয়ে ; তোমরা  জানো এই দেবী কোন জাতের ?তোমরা ভয়ে পুজো করো ,শ্রদ্ধা নেই তোমাদের। কালীও মেয়ে আমরাও মেয়ে। আমাদের অপমান মাকালী র অপমান। আগে নিজের ঘরের কালীমাতা কে সম্মান দাও। উঁচু জাত ,নিচুজাতের দোহাই দিও না। পরিশ্রমের ভাগ নীচু জাতের আর ফলাফলের ভাগ তোমাদের। 
কান্না তখন আর্তনাদের ভাষায়। 
রাশভারী ভুজঙ্গ ভূষণ সেনের  আনুমানিক পাঁচকিলো গ্রাম ওজনের হাত টি স্নেহের পরশ নিয়ে পূর্ণিমার মাথায় যেন সুরক্ষার ছাতা ; রোদ ,বৃষ্টি থেকে দুর্যোগ থেকে রক্ষা করলো। তিনি  বাজখাই কণ্ঠস্বরে গলা টা খাঁকড়িয়ে হুঙ্কার দেন। 
আজ দীপাবলি সবাই খুশির আলোতে এস।
 বড় বড় মাটির সরাতে একশত প্রদীপ সাজিয়ে জ্বালানো হল। পূর্ণিমা ,শামীম ,শ্রমণারা ,বাড়ির বাচ্চারা গোটা বাড়িতে আলোর বন্যা বইয়ে দিলো। মন্দিরে মন্দিরে প্রদীপ জ্বালালো। পুরোনো সেই শিবতলা , যেখানে শ্রমণারা  জ্বালানো প্রদীপের থালা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সকলে গাইত "আলোর ডালায় বরণ  করি মাগো ,  সকাল সাঁঝে মনের ঘরে জাগো। " আজ সুষমা পিসি ,  শামীম, পূর্ণিমারাও গাইছে ,দীপাবলির রাতে মনের আলোগুলো জ্বালাচ্ছে। 

ওঁদের এখন অনেক বয়স হয়েছে ঠাকুমা ,দিদিমা হয়েছে। যে যেখানে থাকুকনা কেন , এখনো কালীপুজোয় পূর্ণিমারা একসাথে নিজের গ্রামে যায় ,প্রদীপ জ্বালায়  ,গান গায় কাঁপাকাঁপা গলায়।  শ্রমণার পাঁচ ভাই কে ভাইফোঁটা দেয়।  সারা বছরে সুস্থতা কামনা করে ওরা সকলের।   পরের বছর আবার আসব এই আশায়  আশায় থাকে।  

Friday 6 October 2017

সদানন্দ
শেষ পর্ব 
#মৌসুমী রায় 
আজ ষষ্ঠীর সকালে বাবার সাথে ভগবতী তলায় এক প্রস্থ বাজিয়ে এসেছে। ফিরে এসে দেখে  বাড়ির বাচ্চারা ঘুমথেকে তখনও ওঠেনি। সদা যখন বাড়িতে থাকে তখন ওর মা একটু দেরি কোরে ঘুমথেকে ওঠায়। যাইহোক বাড়ির গিন্নিমা সদার বাবা কে আর সদা কে চা ,বিস্কুট দিয়েছে। এই বিস্কুট তার ভালো লেগেছে। বাড়ির জেঠিমা আরও কখানা দিয়ে বলেন সদা খেয়ে নে চটপট। সদাইয়ের  শান্ত স্বভাবে সকলের ভালোবাসা পেয়ে থাকে। 
ষষ্ঠীর বোধন হবে বাবা বলেছে আজ বোধনের বাজনা হবে। গাঁয়ে পুজো হয় কিন্তু সেভাবে সদা জড়িয়ে পড়েনি কোনোদিন। খেলাধুলা করেই পুজোর দিনকাটাতো। যে বাড়িতে সদারা আছে ওই বাড়িতেই পুজোর জোগাড় জানতি হচ্ছে। বড়ো পিতলের পড়াতে একছড়া কলা ,কাঁঠাল পাতা গুলো কে নৌকার মতো করে তার মধ্যে কত কি রাখা হয়েছে। প্রদীপ ,ধূপ আরও কতকি। বাবা বললেন এগুলো দিয়ে গণেশের বৌ কলাবৌ তাকে বরণ করা হবে। এটাকে বরণ ডালা বলে। দুগ্গা মায়ের এই একটি পুত্রবধু বুঝলি সদা। তুই যখন বড়ো হবি তখন তোর বৌ কে তোর মা এভাবে বরণ করবে। সদা লজ্জা পেয়ে বলে ধ্যাৎ। মায়ের কথা সদার মনে পড়ে গেলো। মা একা একা পুজো তে কিভাবে কাটাবে। ভাবতে ভাবতে বোধনের বাজনা বেজে ওঠে। 
বোধনের বাজনা ঢাকে বাজছে আর সদা কাইনানা সুরে তালে তালে বাজছে। পুরোহিত যখন মাঝে মাঝে বলছে ঢাকি ,কাঁসি বাজাও তখন। সদাই ,নিতাই নামে কেও ডাকেনা ,বলে ঢাকি ,কাঁসি। দুগ্গা মণ্ডপে বাচ্চারা নতুন জামা পড়ে খেলছে। কেও আবার স্লিপ খাচ্ছে ,ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে। ওই দিকে চোখ চলে যাচ্ছে সদার। ওর ইচ্ছে করছে ওদের সাথে খেলা করতে। বাবা মাঝেমাঝে এই সব দেখছে, সদার মনের কথাও বুঝছে। পুরোহিত বরণ করছে কলাবৌ কে। হুলুধ্বনি ,শাঁখ বাজছে তার সাথে ঢাক ,কাঁসি বেজে চলেছে। তাল বেশ রপ্ত করেছে সদা। 
একটা কলা গাছকে কিভাবে মায়েদের মতো সাজালেন পুরোহিত সদা একমনে দেখলো। প্রথমে কলাগাছের কোমড় পর্যন্ত কলাগাছের ছালদিয়ে শক্ত কোরে বাঁধলো। তারপর গাছের মাঝবরাবর একটি বৃন্তে একজোড়া শ্রীফল মানে বেল ফল বেঁধে দিলো। একটা লালপাড় শাড়ি পড়িয়ে দুগ্গা থানের পাশের ঘরে রাখল। বাবা বললেন এই কলাবৌ কে চতুর্দোলায় চাপিয়ে পুকুরে ঘট ভরতে যাওয়া হবে কাল। আজ কে মা দুগ্গা মৃন্ময়ী থেকে চিন্ময়ী হলেন বুঝলি সদা।
সকালে সপ্তমীর বাজনা বাজিয়ে ঘট্ ভরা হলো। সদার মা ও আজ ঘট ভরল। সদার কচি আঙুল গুলো টনটন করছে বাজাতে বাজাতে। 
কলাবৌয়ের কাছে বাড়ির ছেলেরা মাথায় কোরে ধানের সড়া পেঁচা (কাঠের ) এনে রেখেছে। সপ্তমীর সন্ধ্যারতি হয়েগেলো। আজ অনেক ক্ষণ বাজিয়েছে। পা টাও ব্যথা করছে। বাবাকে কিছুবলেনি সদা ,পাছে বাবার কষ্ট হয়। .খাওয়া হল ,ঘুমঘুম আসছে বাইরে মাইক বাজছে। গান বাজছে গৌরী এলো দেখে যা লো ,ভবেরও ভবানী আমার ভবন করিল আলো। ঢাকের আওয়াজ কাঁসির আওয়াজ শুনতেশুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
বাবা  বলেছে অষ্টমী পুজোতে অনেক ক্ষণ বাজাতে হবে। ক্ষণের পুজো হবে। বলীর বাজনা হবে। এখানে বলী হয়না ,এটাই রক্ষে। নিতাই ঢাকি জেনেই বায়না ধরেছিলো। নিপুন হাতে বাবার  সাথে সঙ্গত করলো সদা। 
আর দুদিন পরেই মায়ের কাছে যাবে সদা। খুব আনন্দ হচ্ছে। নবমী ,দশমী র সকাল বাজালো। বিসর্জনে পাড়ার দাদা ,কাকারা বাজাবে। নাচবে ধুনুচি নিয়ে ,ঢাক বাজানোর প্রতিযোগিতা হবে। 
সদার আঙুলগুলো কালসিটে পড়েগিয়েছে। ব্যথায় টনটন করছে। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। খুব বেদনা করছে নারে সদা। সদা ঘাড় নাড়ে। বাবা বলেছে দ্বাদশীতে বাড়ি যাবে। তবে এবার আর অত হাঁটতে হবে না ,ভ্যানে নিয়ে যাবে। একাদশীতে গাঁয়ের বাড়িবাড়ি ঢাক বাজিয়ে আসবে। সব বাড়ির গিন্নিরা চালভাজা।,মুড়ি ,নাড়ু ,মুড়কি ,চাল ,সর্ষে তেল ,বাস তেল দেবে। সদা বলে তাই হবে বাবা। গাঁয়ের পুজো থেকেও নতুন ধুতি ,জামা ,মায়ের শাড়িও পেয়েছে। 
পথেযেতে মায়ের জন্য হিমানী পাওডার ,চিরুনি ,আলতা সিঁদুর কিনেছে বাপব্যাটা। 
মা আজ পুকুরে নাইতে দেবেনা সদা কে। পুকুর থেকে জল তুলে রেখেছে মা।  বাছার নাজানি কত কষ্ট হয়েছে। লোকের বাড়িথেকে পুজোতে এটাওটা পেয়েছে। ভালোমন্দ রেঁধেছে। 
সদা রাস্তা থেকে হাঁক পারছে মা। ছুট্টে ধুলো পায়ে মায়ের কোলে। সাথে সাথে পোঁটলা খুলে নাড়ু মায়ের মুখে দিয়ে দিলো। 
সদার আঙুল গুলো দেখে মায়ের চোখে জলের ধারা বইতে লাগলো। অভাবে থাকলেও আর সদাকে কাঁসি বাজাতে পাঠাবে না। পুজোর খুঁটিনাটি সবগল্প ,ওই বাড়ির জেঠিমা যে সদাকে একদিন খুব যত্ন করেছে মা কে সব বৃত্তান্ত বলাহল। 
ইসকুল খুললে দিদিমণি দেরও সব গল্প করে পুজোর। তবে খুব কষ্ট হয়েছে। আঙুল গুলো দেখিয়ে বলে এগুলো কালো হয়ে গিয়েছিলো। ব্যথা করত হাতে ,পায়ে। দিদিমণির আলোচনা করে ঠিক করলেন আর সদাই কে এই কাজ করতে দেওয়া হবেনা। পড়াশুনো কোরে মানুষ হতে হবে। এই গাঁয়ের পঞ্চায়েত প্রধানের সাথে কথা বলে ঠিক হলো ,শিশু  শ্রম বন্ধ করতে হবে। এর উপায় গাঁয়ের ধনী মানুষের সাহায্য।,পঞ্চায়েত এর সাহায্য আর দিদিমণিদের আর্থিক সাহায্যে ফান্ড হবে। গ্রামের যুবক ,যুবতীরা দ্বায়িত্ব পালন করবে। পুজোয় নতুন জামা ,জুতো দেওয়া হবে। সারা বছর মিডডে মিল চালু থাকবে। সদাইয়ের মতো ছেলে মেয়েরা যেন আগামীতে দেশের সুস্থ নাগরিক হয়ে ওঠে। আর কোনোদিন নিজের নামের বদলে ঢাকি ,কাঁসি বলে কেও ডাকবে না। 

Thursday 5 October 2017

সদানন্দ
১ 
#মৌসুমী রায় 
শুনেছ সদার মা বীরভূমের প্রসাদপুর গাঁ থেকে পুজোতে ঢাকির বায়না পেলাম। কাঁসির বায়নাটাও নিলাম গো। সদা কে সাথে লিয়ে যাব ,এবার কটা টাকা বেশি আসবে। বাপ্ ব্যাটা মিলে বাজাব ,ছ -সাত দিন ব্যাটা টা ভালো মন্দ খেতে পাবে। তোমার লেগেও বেঁধে আনবো বুঝলে সদার মা। শুনে সদার মা ভালোমন্দ কিছু বুঝে উঠতে পারেনা। একবার ভাবে বেশ হবে বাছা আমার পুজোর দিনে এটা সেটা খেতে পাবে। বাড়ি থাকলে কলমি শাক আর ভাত খায় ,মাঝে মাঝে চুনো মাছের অম্বল। একটু চাকুন চিকুন হবে। 
সদার নাম সদাই গাঁয়ে সদা বলে ডাকে আর সদাইয়ের বাবার নাম নিতাই ঢাকি। মায়ের নাম ধরে কেউ ডাকেনা ,সবাই বলে সদার মা। সদার ছয় -সাত বছর হবে। গাঁয়ের শিশু শ্রেণী থেকে এবারে প্রথম শ্রেণীতে উঠেছে। বাবা অত লেখাপড়ার মর্ম বোঝেনা ,বলে সদা বড় হয়ে বাবার থেকেও বড়ো ঢাকি হবে। কিন্তু সদার মায়ের চেষ্টা ও লেখাপড়া শিখে শিক্ষক হোক। সদার মত যারা নিত্য অভাবে দিনকাটে তাদের শিক্ষিত কোরে তুলুক। ঢাকির পেশায় যেন উপার্জন করতে না হয়। এ পেশা যে ভাবের ঘরে অভাবের। 
সদার মা ওকে প্রতিদিন গাঁয়ের প্রাথমিক ইস্কুলে পাঠায়। পড়াও হয় আবার একবেলার খাবারও হয়। ইদানিং দিদিমণিরা মিডডে মিলের বেঁচে যাওয়া খাবার বাচ্চাদের ভাগকরে দেয়। বাড়ি আনে ওরা ছোট ভাইবোন রা খায়। সদার ভাইবোন নেই ও একাই ,তাই মা বাবার জন্য আনে। 
দিদিমণিরা সদাই কে খুব ভালো বাসেন। পড়াতে মনোযোগ খুব ছেলেটার ,আবার খেলাধূলাতেও। ইস্কুলে স্পোটর্সে দৌড় প্রতিযোগিতা আর অঙ্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় সেই শিশু শ্রেণী থেকে। দিদিমণিরা যে টিফিন আনে সেটাতেও সদার ভাগ থাকে। দুটো কচি হাত খাবারে ভোরে যায়। চাঁদ মুখ করে খেয়ে নিয়ে টিউবয়েল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে নেয়। সদার তৃপ্তি চোখদুটো কথা বলে। দিদিমণিরা মাঝে মধ্যে ওর গাল টিপে দেয়। সদার বাবা গাঁয়ে সবার থেকে কমা। কিন্তু মানুষ হিসেবে খুব ভালো। সাত চড়ে রা নেই। সদা কে সকলে খুব ভালোবাসে। 
সদার বাবার সাথে কাঁসি বাজাতে যাওয়ার মন নেই। ইস্কুলে যেতে ভালো লাগে। তারপর ওর ইসকুল ছুটি পঞ্চমীতে। বাবা বলছে তৃতীয়া তে বেড়োতে হবে। চতুর্থীর দিন পৌঁছতে হবে ,পঞ্চমীর সকাল থেকে ঢাকির বায়না। পুজোর পরেই পরীক্ষা। বুঝিয়ে সুঝিয়ে মা বাবার সাথে পাঠালো। সাথে মুড়ি চিড়ে গুড় নিয়েছে বাবা। ইস্টিলের ঘটিতে জল নিয়েছে। পথে খাবে। ফুরোলে আবার ভরে নেবে। পাঁচ ক্রোশ হেঁটে তবেই বাসে চাপতে পারবে। 
আসার সময় ঘোমটার আড়ালে মায়ের চোখে জল দেখেছিলো। পুজোতে সবাই মা এর কাছে থাকে শুধু সদার মা ওর সাথে থাকবে না। খুব মন খারাপ আজ। 
জমির আল ধরে বাপ্ ব্যাটা হাঁটছে। দুধারে সবুজ ধান গাছ ,কোনোটাতে ধানের শিস হয়েছে। শরতের নীল আকাশ আর রোদের ঝিকিমিকি আবার হাওয়ায় ধানগাছ গুলো দুলছে। মাঝে মধ্যে আলতো হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সদা। হাঁটে আর মাঝে মাঝে গান গায় আনন্দ লোকে মঙ্গলা লোকে। বাবা বলে বেশ তো গান টা। কোথা শিখলি সদা বাবা শুধাই। বলে ইসকুলে প্রার্থনা হয়। জানো বাবা আরো গান হয় বন্দে মাতরম আর জনগণ। দিদিমণিরা বলেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা জনগণ আর আনন্দলোকে। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বন্দে মা তরম। বাবা সদার কথা গান শোনে আর মাঝে মাঝে বলে জোরে পা চালা বাস টা ফগলে না  যায়। পায়ে ব্যথা করে সদার হাঁটতে হাঁটতে। চিড়ে গুড় খেয়ে আবার হাঁটে। বাস ধরে স্ট্যান্ডে নামে। আবার হাঁটতে হাঁটতে প্রসাদপুর পৌঁছায়। গাঁয়ে ঢোকার মুখে পঞ্চমীর ঢাক বাজাচ্ছে বাবা  আর তালে তালে কাঁসি বাজছে সদার কচি হাতদুটোতে। ভগবতী তলায় বাবা ঢাক বাজানোতে গাঁয়ের বাচ্চা বুড়ো হাজির।  বাবা বলে দিয়েছে ঢাক বাজলেই কাঁসি বাজাতে হবে। 
খানিক বাদে বাপ্ ব্যাটাকে একটা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। পুজোর কটাদিন এখানেই থাকবে ওরা। ওর মত কয়েকটা বাচ্চা নতুন জামাপরে খেলা করছে। ------