পূর্ণিমা
# মৌসুমী রায়
বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম এ ভুজঙ্গ ভূষণ সেন শর্মার নিজ গৃহে কালী পূজার প্রস্তুতি চলত দুর্গাপুজোর দশমীর পরের দিন থেকে। কারণ পুকুর ঘাট থেকে এঁটেল মাটি তুলে এনে শখানেক প্রদীপ গড়তে হত ,শুকোতে দিতে হতো , এমনকি আগুনে পুড়িয়ে একেবারে শক্ত পোক্ত করে একটা বাঁশের ছিলা দিয়ে বানানো ঝুড়ি তে ভরে চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরে এককোনে রেখে দেওয়াহত ,বাচ্চাদের নাগালের বাইরে। প্রদীপের সর্ষের তেল থেকে সলতে সব কিছুই বাড়ির তৈরী ; জমির সর্ষে পিষিয়ে তেল হত ,বাড়িতে কার্পাস তুলোর গাছ আবার শিমুল তুলোরও। কাপাস তুলোর সলতে পাকানো হতো । গিন্নিমারা দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে ছালের কাপড়পড়ে সলতে পাকাতেন। সে এক ধুম বটে বাড়িতে। ওই সব দেখতে গিয়ে পড়াশোনা মাথায় উঠতো আরকি। পড়তেও হত পুজোর ছুটির পরে পরে ক্লাসে ওঠার পরীক্ষা। কি রাগ হতো কী বলব। সব রাগ পড়ত ওই বিদ্যা সাগর মহাশয়ের ওপর।
সমস্ত কাজ নিপুণহাতে সম্পন্ন করত ওই বাড়ির পরিচারিকা সুষমা মুর্মু আর ওর মেয়ে পুন্নুমা ছাড়াও আরও একজন ওই বাড়ির মেয়ে শ্রমণার ছোটবেলার বন্ধু শামীম। পুন্নুমার নাম পূর্ণিমা কিন্তু ওর বাড়ির সবাই পুন্নিমা আর পুন্নুমা বলেই ডাকত , এবাড়ির সকলে পূর্ণিমা বলে। পূর্ণিমার গায়ের রং শ্যামলা ,চোখদুটো উজ্বল সবসময় যেন কথা বলে ;আর নাক টা চাপা হলেও ওকে কৃষ্ণকলি অনায়াসে বলা যাই ;সুষমা পিসির তাতে সাই নেই ,সুতরাং ওকে পুন্নুমা ডাকতে হবে। আর শামীম ? শ্রমণা দের গাঁয়ের ,পাশের গাঁয়ে থাকে ,ছোটবেলা থেকে এবাড়িতে ওর আব্বু হাকিম শেখের সাথে আসত ,সেইথেকে শ্রমণারা তিন বন্ধু। হাকিম চাচা আবার ভুশুনসেনের সর্বক্ষণের বিশ্বস্ত সঙ্গী। ভুজঙ্গ ভূষণ কে সকলে ভুশুনসেন নামেই ডাকতেন ,ও হ্যাঁ সেন মহাশয় তাঁর নামে ধারে ভারে কাটেন ;তিনি যা বলবেন তাই হবে এই কথা সকলের জানা।
প্রথম প্রথম বাড়ির গিন্নিমার ছোঁয়াছুঁয়ি ,এটা ধরবেনা ,ওটা নাড়বেনা গোছের শুচি বায়ু চাগাড় দিত। এমনকী কলাইকরা সানকি থালায় ওঁদের খেতে দিতেন ,সিমেন্ট বাঁধানো মেঝের এঁটো শুকরি গোবর দিয়ে ধুতে বলতেন ;বাড়ির খিড়কি দরজা থেকে সদর সমস্ত টা ই গোবর জলের লেপন থাকত। পাকা বাড়ির সর্বত্র গোবর এর গন্ধে তিষ্ঠোনো যেতনা। সেন বাড়িতে কত লোকজন আসতেন , প্রথম অভ্যর্থনা হতো এক কাঁসার ডিস্ এ গুড়ের বাতাসা আর কাঁসার ঘটিতে জল ; কাঁসার গেলাসে ও জল টলটল করত, এমনকি গেলাসটি এমন চকচক করতো যে মুখ দেখা যেত। তাহলে হবে কি একচুমুক দিলেই গোবর গোবর গন্ধ। লোকজন বাতাসা খেয়েই তুষ্ট হতেন তেষ্টায় ছাতি ফাটলেও জলমুখো হতেননা।
এসব ভুশুনসেনের নজর এড়াতনা , তাই গোয়ালঘরের গোবর ওই গোয়াল পর্যন্ত রইল ,বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ নিষিদ্ধ হল।
কালীপুজোর আগে যখন শ্রমণারা তিনবন্ধু ছোটছিল তখন সুষমা পিসি সব করত। মানে প্রদীপ তৈরী করা থেকে শুকানো ,শুকনো প্রদীপ চিলেকোঠা থেকে নামানো। সব পরিশ্রমের কাজ সুষমা পিসির ,আর গিন্নিমাদের কাজ সেই প্রদীপ জ্বালিয়ে মন্দিরে মন্দিরে দেওয়া ,খিড়কি থেকে সদর পর্যন্ত পুত্র বধূরা সাজাতেন। প্রদীপ জ্বালানোতে সুষমার ছোঁয়া অশুচি হবে।
এমনই এক কালীপুজোর আগের রাত্রে ভূতচতুর্দশী তে পুর্ণিমা বলে দাদামশাই,এ কেমন রীতি গো তোমাদের ;আমরা সাঁওতাল বটি ,নীচু জাত কিন্তু চোদ্দ শাক তুলে আনি ,প্রদীপ গড়ি ,তোমাদের খাবার জল আনি। কিন্তু মন্দিরে উঠে দীপাবলির দিনে দীপ জ্বালাতে পারিনা। কেননা আমরা নীচু জাত। আবার শামীম দিদি , আমি শ্রমণা দিদি একসাথে খেলাকরি ,স্কুলে যাই সেখানে স্যার ,দিদিমণিরা তফাৎ পড়ান না। তাহলে শামীমদিদি ,আমি ,আমার মা কেন দীপ জ্বালাবোনা বলতে পারো ? অঝোরে পূর্ণিমার দুই গাল অশ্রুধারায় সিক্ত ,সিক্ত ঠোঁট দুটি প্রতিবাদের ভাষায় কাঁপছে।
আজ প্রতিবাদ ভাষার সার্থক জন্ম লাভ করেছে ,সবাই স্তব্ধ সুঁচ পড়লে তার শব্দ ও যেন অনুরণন সৃষ্টি করবে।
এখনও থামেনি পূর্ণিমা বলেই চলেছে অবহেলা ,অনুকম্পা ,অশ্রদ্ধার ,বঞ্চনার কথা।
মাকালী ?সেওতো এক মেয়ে ; তোমরা জানো এই দেবী কোন জাতের ?তোমরা ভয়ে পুজো করো ,শ্রদ্ধা নেই তোমাদের। কালীও মেয়ে আমরাও মেয়ে। আমাদের অপমান মাকালী র অপমান। আগে নিজের ঘরের কালীমাতা কে সম্মান দাও। উঁচু জাত ,নিচুজাতের দোহাই দিও না। পরিশ্রমের ভাগ নীচু জাতের আর ফলাফলের ভাগ তোমাদের।
কান্না তখন আর্তনাদের ভাষায়।
রাশভারী ভুজঙ্গ ভূষণ সেনের আনুমানিক পাঁচকিলো গ্রাম ওজনের হাত টি স্নেহের পরশ নিয়ে পূর্ণিমার মাথায় যেন সুরক্ষার ছাতা ; রোদ ,বৃষ্টি থেকে দুর্যোগ থেকে রক্ষা করলো। তিনি বাজখাই কণ্ঠস্বরে গলা টা খাঁকড়িয়ে হুঙ্কার দেন।
আজ দীপাবলি সবাই খুশির আলোতে এস।
বড় বড় মাটির সরাতে একশত প্রদীপ সাজিয়ে জ্বালানো হল। পূর্ণিমা ,শামীম ,শ্রমণারা ,বাড়ির বাচ্চারা গোটা বাড়িতে আলোর বন্যা বইয়ে দিলো। মন্দিরে মন্দিরে প্রদীপ জ্বালালো। পুরোনো সেই শিবতলা , যেখানে শ্রমণারা জ্বালানো প্রদীপের থালা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সকলে গাইত "আলোর ডালায় বরণ করি মাগো , সকাল সাঁঝে মনের ঘরে জাগো। " আজ সুষমা পিসি , শামীম, পূর্ণিমারাও গাইছে ,দীপাবলির রাতে মনের আলোগুলো জ্বালাচ্ছে।
ওঁদের এখন অনেক বয়স হয়েছে ঠাকুমা ,দিদিমা হয়েছে। যে যেখানে থাকুকনা কেন , এখনো কালীপুজোয় পূর্ণিমারা একসাথে নিজের গ্রামে যায় ,প্রদীপ জ্বালায় ,গান গায় কাঁপাকাঁপা গলায়। শ্রমণার পাঁচ ভাই কে ভাইফোঁটা দেয়। সারা বছরে সুস্থতা কামনা করে ওরা সকলের। পরের বছর আবার আসব এই আশায় আশায় থাকে।