Thursday 5 October 2017

সদানন্দ
১ 
#মৌসুমী রায় 
শুনেছ সদার মা বীরভূমের প্রসাদপুর গাঁ থেকে পুজোতে ঢাকির বায়না পেলাম। কাঁসির বায়নাটাও নিলাম গো। সদা কে সাথে লিয়ে যাব ,এবার কটা টাকা বেশি আসবে। বাপ্ ব্যাটা মিলে বাজাব ,ছ -সাত দিন ব্যাটা টা ভালো মন্দ খেতে পাবে। তোমার লেগেও বেঁধে আনবো বুঝলে সদার মা। শুনে সদার মা ভালোমন্দ কিছু বুঝে উঠতে পারেনা। একবার ভাবে বেশ হবে বাছা আমার পুজোর দিনে এটা সেটা খেতে পাবে। বাড়ি থাকলে কলমি শাক আর ভাত খায় ,মাঝে মাঝে চুনো মাছের অম্বল। একটু চাকুন চিকুন হবে। 
সদার নাম সদাই গাঁয়ে সদা বলে ডাকে আর সদাইয়ের বাবার নাম নিতাই ঢাকি। মায়ের নাম ধরে কেউ ডাকেনা ,সবাই বলে সদার মা। সদার ছয় -সাত বছর হবে। গাঁয়ের শিশু শ্রেণী থেকে এবারে প্রথম শ্রেণীতে উঠেছে। বাবা অত লেখাপড়ার মর্ম বোঝেনা ,বলে সদা বড় হয়ে বাবার থেকেও বড়ো ঢাকি হবে। কিন্তু সদার মায়ের চেষ্টা ও লেখাপড়া শিখে শিক্ষক হোক। সদার মত যারা নিত্য অভাবে দিনকাটে তাদের শিক্ষিত কোরে তুলুক। ঢাকির পেশায় যেন উপার্জন করতে না হয়। এ পেশা যে ভাবের ঘরে অভাবের। 
সদার মা ওকে প্রতিদিন গাঁয়ের প্রাথমিক ইস্কুলে পাঠায়। পড়াও হয় আবার একবেলার খাবারও হয়। ইদানিং দিদিমণিরা মিডডে মিলের বেঁচে যাওয়া খাবার বাচ্চাদের ভাগকরে দেয়। বাড়ি আনে ওরা ছোট ভাইবোন রা খায়। সদার ভাইবোন নেই ও একাই ,তাই মা বাবার জন্য আনে। 
দিদিমণিরা সদাই কে খুব ভালো বাসেন। পড়াতে মনোযোগ খুব ছেলেটার ,আবার খেলাধূলাতেও। ইস্কুলে স্পোটর্সে দৌড় প্রতিযোগিতা আর অঙ্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় সেই শিশু শ্রেণী থেকে। দিদিমণিরা যে টিফিন আনে সেটাতেও সদার ভাগ থাকে। দুটো কচি হাত খাবারে ভোরে যায়। চাঁদ মুখ করে খেয়ে নিয়ে টিউবয়েল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে নেয়। সদার তৃপ্তি চোখদুটো কথা বলে। দিদিমণিরা মাঝে মধ্যে ওর গাল টিপে দেয়। সদার বাবা গাঁয়ে সবার থেকে কমা। কিন্তু মানুষ হিসেবে খুব ভালো। সাত চড়ে রা নেই। সদা কে সকলে খুব ভালোবাসে। 
সদার বাবার সাথে কাঁসি বাজাতে যাওয়ার মন নেই। ইস্কুলে যেতে ভালো লাগে। তারপর ওর ইসকুল ছুটি পঞ্চমীতে। বাবা বলছে তৃতীয়া তে বেড়োতে হবে। চতুর্থীর দিন পৌঁছতে হবে ,পঞ্চমীর সকাল থেকে ঢাকির বায়না। পুজোর পরেই পরীক্ষা। বুঝিয়ে সুঝিয়ে মা বাবার সাথে পাঠালো। সাথে মুড়ি চিড়ে গুড় নিয়েছে বাবা। ইস্টিলের ঘটিতে জল নিয়েছে। পথে খাবে। ফুরোলে আবার ভরে নেবে। পাঁচ ক্রোশ হেঁটে তবেই বাসে চাপতে পারবে। 
আসার সময় ঘোমটার আড়ালে মায়ের চোখে জল দেখেছিলো। পুজোতে সবাই মা এর কাছে থাকে শুধু সদার মা ওর সাথে থাকবে না। খুব মন খারাপ আজ। 
জমির আল ধরে বাপ্ ব্যাটা হাঁটছে। দুধারে সবুজ ধান গাছ ,কোনোটাতে ধানের শিস হয়েছে। শরতের নীল আকাশ আর রোদের ঝিকিমিকি আবার হাওয়ায় ধানগাছ গুলো দুলছে। মাঝে মধ্যে আলতো হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সদা। হাঁটে আর মাঝে মাঝে গান গায় আনন্দ লোকে মঙ্গলা লোকে। বাবা বলে বেশ তো গান টা। কোথা শিখলি সদা বাবা শুধাই। বলে ইসকুলে প্রার্থনা হয়। জানো বাবা আরো গান হয় বন্দে মাতরম আর জনগণ। দিদিমণিরা বলেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা জনগণ আর আনন্দলোকে। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বন্দে মা তরম। বাবা সদার কথা গান শোনে আর মাঝে মাঝে বলে জোরে পা চালা বাস টা ফগলে না  যায়। পায়ে ব্যথা করে সদার হাঁটতে হাঁটতে। চিড়ে গুড় খেয়ে আবার হাঁটে। বাস ধরে স্ট্যান্ডে নামে। আবার হাঁটতে হাঁটতে প্রসাদপুর পৌঁছায়। গাঁয়ে ঢোকার মুখে পঞ্চমীর ঢাক বাজাচ্ছে বাবা  আর তালে তালে কাঁসি বাজছে সদার কচি হাতদুটোতে। ভগবতী তলায় বাবা ঢাক বাজানোতে গাঁয়ের বাচ্চা বুড়ো হাজির।  বাবা বলে দিয়েছে ঢাক বাজলেই কাঁসি বাজাতে হবে। 
খানিক বাদে বাপ্ ব্যাটাকে একটা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। পুজোর কটাদিন এখানেই থাকবে ওরা। ওর মত কয়েকটা বাচ্চা নতুন জামাপরে খেলা করছে। ------








No comments:

Post a Comment