Friday 6 October 2017

সদানন্দ
শেষ পর্ব 
#মৌসুমী রায় 
আজ ষষ্ঠীর সকালে বাবার সাথে ভগবতী তলায় এক প্রস্থ বাজিয়ে এসেছে। ফিরে এসে দেখে  বাড়ির বাচ্চারা ঘুমথেকে তখনও ওঠেনি। সদা যখন বাড়িতে থাকে তখন ওর মা একটু দেরি কোরে ঘুমথেকে ওঠায়। যাইহোক বাড়ির গিন্নিমা সদার বাবা কে আর সদা কে চা ,বিস্কুট দিয়েছে। এই বিস্কুট তার ভালো লেগেছে। বাড়ির জেঠিমা আরও কখানা দিয়ে বলেন সদা খেয়ে নে চটপট। সদাইয়ের  শান্ত স্বভাবে সকলের ভালোবাসা পেয়ে থাকে। 
ষষ্ঠীর বোধন হবে বাবা বলেছে আজ বোধনের বাজনা হবে। গাঁয়ে পুজো হয় কিন্তু সেভাবে সদা জড়িয়ে পড়েনি কোনোদিন। খেলাধুলা করেই পুজোর দিনকাটাতো। যে বাড়িতে সদারা আছে ওই বাড়িতেই পুজোর জোগাড় জানতি হচ্ছে। বড়ো পিতলের পড়াতে একছড়া কলা ,কাঁঠাল পাতা গুলো কে নৌকার মতো করে তার মধ্যে কত কি রাখা হয়েছে। প্রদীপ ,ধূপ আরও কতকি। বাবা বললেন এগুলো দিয়ে গণেশের বৌ কলাবৌ তাকে বরণ করা হবে। এটাকে বরণ ডালা বলে। দুগ্গা মায়ের এই একটি পুত্রবধু বুঝলি সদা। তুই যখন বড়ো হবি তখন তোর বৌ কে তোর মা এভাবে বরণ করবে। সদা লজ্জা পেয়ে বলে ধ্যাৎ। মায়ের কথা সদার মনে পড়ে গেলো। মা একা একা পুজো তে কিভাবে কাটাবে। ভাবতে ভাবতে বোধনের বাজনা বেজে ওঠে। 
বোধনের বাজনা ঢাকে বাজছে আর সদা কাইনানা সুরে তালে তালে বাজছে। পুরোহিত যখন মাঝে মাঝে বলছে ঢাকি ,কাঁসি বাজাও তখন। সদাই ,নিতাই নামে কেও ডাকেনা ,বলে ঢাকি ,কাঁসি। দুগ্গা মণ্ডপে বাচ্চারা নতুন জামা পড়ে খেলছে। কেও আবার স্লিপ খাচ্ছে ,ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে। ওই দিকে চোখ চলে যাচ্ছে সদার। ওর ইচ্ছে করছে ওদের সাথে খেলা করতে। বাবা মাঝেমাঝে এই সব দেখছে, সদার মনের কথাও বুঝছে। পুরোহিত বরণ করছে কলাবৌ কে। হুলুধ্বনি ,শাঁখ বাজছে তার সাথে ঢাক ,কাঁসি বেজে চলেছে। তাল বেশ রপ্ত করেছে সদা। 
একটা কলা গাছকে কিভাবে মায়েদের মতো সাজালেন পুরোহিত সদা একমনে দেখলো। প্রথমে কলাগাছের কোমড় পর্যন্ত কলাগাছের ছালদিয়ে শক্ত কোরে বাঁধলো। তারপর গাছের মাঝবরাবর একটি বৃন্তে একজোড়া শ্রীফল মানে বেল ফল বেঁধে দিলো। একটা লালপাড় শাড়ি পড়িয়ে দুগ্গা থানের পাশের ঘরে রাখল। বাবা বললেন এই কলাবৌ কে চতুর্দোলায় চাপিয়ে পুকুরে ঘট ভরতে যাওয়া হবে কাল। আজ কে মা দুগ্গা মৃন্ময়ী থেকে চিন্ময়ী হলেন বুঝলি সদা।
সকালে সপ্তমীর বাজনা বাজিয়ে ঘট্ ভরা হলো। সদার মা ও আজ ঘট ভরল। সদার কচি আঙুল গুলো টনটন করছে বাজাতে বাজাতে। 
কলাবৌয়ের কাছে বাড়ির ছেলেরা মাথায় কোরে ধানের সড়া পেঁচা (কাঠের ) এনে রেখেছে। সপ্তমীর সন্ধ্যারতি হয়েগেলো। আজ অনেক ক্ষণ বাজিয়েছে। পা টাও ব্যথা করছে। বাবাকে কিছুবলেনি সদা ,পাছে বাবার কষ্ট হয়। .খাওয়া হল ,ঘুমঘুম আসছে বাইরে মাইক বাজছে। গান বাজছে গৌরী এলো দেখে যা লো ,ভবেরও ভবানী আমার ভবন করিল আলো। ঢাকের আওয়াজ কাঁসির আওয়াজ শুনতেশুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
বাবা  বলেছে অষ্টমী পুজোতে অনেক ক্ষণ বাজাতে হবে। ক্ষণের পুজো হবে। বলীর বাজনা হবে। এখানে বলী হয়না ,এটাই রক্ষে। নিতাই ঢাকি জেনেই বায়না ধরেছিলো। নিপুন হাতে বাবার  সাথে সঙ্গত করলো সদা। 
আর দুদিন পরেই মায়ের কাছে যাবে সদা। খুব আনন্দ হচ্ছে। নবমী ,দশমী র সকাল বাজালো। বিসর্জনে পাড়ার দাদা ,কাকারা বাজাবে। নাচবে ধুনুচি নিয়ে ,ঢাক বাজানোর প্রতিযোগিতা হবে। 
সদার আঙুলগুলো কালসিটে পড়েগিয়েছে। ব্যথায় টনটন করছে। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। খুব বেদনা করছে নারে সদা। সদা ঘাড় নাড়ে। বাবা বলেছে দ্বাদশীতে বাড়ি যাবে। তবে এবার আর অত হাঁটতে হবে না ,ভ্যানে নিয়ে যাবে। একাদশীতে গাঁয়ের বাড়িবাড়ি ঢাক বাজিয়ে আসবে। সব বাড়ির গিন্নিরা চালভাজা।,মুড়ি ,নাড়ু ,মুড়কি ,চাল ,সর্ষে তেল ,বাস তেল দেবে। সদা বলে তাই হবে বাবা। গাঁয়ের পুজো থেকেও নতুন ধুতি ,জামা ,মায়ের শাড়িও পেয়েছে। 
পথেযেতে মায়ের জন্য হিমানী পাওডার ,চিরুনি ,আলতা সিঁদুর কিনেছে বাপব্যাটা। 
মা আজ পুকুরে নাইতে দেবেনা সদা কে। পুকুর থেকে জল তুলে রেখেছে মা।  বাছার নাজানি কত কষ্ট হয়েছে। লোকের বাড়িথেকে পুজোতে এটাওটা পেয়েছে। ভালোমন্দ রেঁধেছে। 
সদা রাস্তা থেকে হাঁক পারছে মা। ছুট্টে ধুলো পায়ে মায়ের কোলে। সাথে সাথে পোঁটলা খুলে নাড়ু মায়ের মুখে দিয়ে দিলো। 
সদার আঙুল গুলো দেখে মায়ের চোখে জলের ধারা বইতে লাগলো। অভাবে থাকলেও আর সদাকে কাঁসি বাজাতে পাঠাবে না। পুজোর খুঁটিনাটি সবগল্প ,ওই বাড়ির জেঠিমা যে সদাকে একদিন খুব যত্ন করেছে মা কে সব বৃত্তান্ত বলাহল। 
ইসকুল খুললে দিদিমণি দেরও সব গল্প করে পুজোর। তবে খুব কষ্ট হয়েছে। আঙুল গুলো দেখিয়ে বলে এগুলো কালো হয়ে গিয়েছিলো। ব্যথা করত হাতে ,পায়ে। দিদিমণির আলোচনা করে ঠিক করলেন আর সদাই কে এই কাজ করতে দেওয়া হবেনা। পড়াশুনো কোরে মানুষ হতে হবে। এই গাঁয়ের পঞ্চায়েত প্রধানের সাথে কথা বলে ঠিক হলো ,শিশু  শ্রম বন্ধ করতে হবে। এর উপায় গাঁয়ের ধনী মানুষের সাহায্য।,পঞ্চায়েত এর সাহায্য আর দিদিমণিদের আর্থিক সাহায্যে ফান্ড হবে। গ্রামের যুবক ,যুবতীরা দ্বায়িত্ব পালন করবে। পুজোয় নতুন জামা ,জুতো দেওয়া হবে। সারা বছর মিডডে মিল চালু থাকবে। সদাইয়ের মতো ছেলে মেয়েরা যেন আগামীতে দেশের সুস্থ নাগরিক হয়ে ওঠে। আর কোনোদিন নিজের নামের বদলে ঢাকি ,কাঁসি বলে কেও ডাকবে না। 

No comments:

Post a Comment