Sunday 25 August 2019

আবর্তন  
#মৌসুমী রায় 
চার দেওয়ালের একমুঠো মনের কুঠুরি এঁটে বসে  থাকেনি অনন্যা।  নামের মাঝেই লুকিয়ে ছিল বর্ণনা।
 ছোট্ট থেকে সেই ভাবে পায় নি মা ,বাবার আদর যত্ন। বাসা বেঁধেছিল মনে, হবে এক   আলোকবর্তিকা।  চরম অভাব  তাঁকে কাবু করতে পারেনি। আক্ষেপ ছিল। কিন্তু ভাগ্যের দোষারোপ ছিলনা তাঁর। 
  ছোট কুঁড়ে ঘরেই বড় হয়ে একের পর এক মাইল স্টোন পেরিয়ে কলকাতার নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী।
 ও বোঝে মানুষ হওয়া। ধনী ,গরীব নয়। 
 অজান্তেই ভালোবেসে ফেলে একজনকে। সেও ভালো মানুষ। কয়েক বছর পর তুমুল এক ঝড় লন্ডভন্ড করে দেয় সমস্ত কিছুই। পরিণতি  পায়নি। তবুও অনন্যা থেমে যায়নি। নানান প্রতিভা আজও বিকশিত তাঁর। ও  জানে  থেমে গেলে স্বার্থপর সমাজ তাঁকে নিয়ে সমালোচনা করবে।
 ত্রুটি খুঁজবে........................
আজও নতুন পথেই হাঁটছে ও..................... 
 হয়ত অনেক বড় মানুষের খোঁজে অনন্যা..........................
এটাই ওঁর স্পিরিট ........................................
 শাবাস অনন্যা .................................

লগনি মা

লগনি মা...
#মৌসুমী রায়
জানিস লগনি মা,আমি আজ যেই খানটিতে  রইছি ,সেই খান টির  গল্প বুলব তোকে। আমি লতুন ভাষা শিখেছি,চাল চলন সবই লতুন রে। কিন্তু শহুরে ভাষা টো তে লিখবো নাই... ইটোতে জি মাটির গন্ধ নাই রে লগনি মা।
তা শুন, সেই তোর ছুটো বেলাকার  কামিন  থেকে মেঝেন থেকে আমি আজকের দামিণি হইছি তারই গল্প বুলব বুঝলি... ঘুমান গেলি নাকি? চুখে জল দে লয়ত সূর্ষের ত্যাল ডড্ডিঙ লে খানিক।
বিশ বছর পূর্বের কথা, তু গাঁয়ের বাবুদের বাড়ি গুলাতে কামিন করতিস ,ওই জি রে গোয়াল কারতিস,খিরকি হোতে সদর পর্যন্থই গোবর ছড়া দিতিস ,দিয়ালে ঘসি দিতিস ,পোড়া পোড়া হাঁড়ি ,কড়া গুলান খ্যারের ল্যা তা তে ছাই মাখিঙ লেচে লেচে মাঝ তিস! সব দেখ্যাছি। ওরা তুকে তো কাজ করিং লিথই আবার আমাকেও বুলথ ইটো উটো করতে।
তু কোমড়ে কাপড় খান গাছ কোমড় কোরে ঝুঁটি নারিং বুলথিস,"হ্যাঁ গো বাবু , তুমরা কি ভাব যে আমার বিটি টাও আমার মথই কামিন গিরি করুক?"... সেই শুনে বাবুদের গিন্নি রাও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য কোরে ঘোমটার আড়ালে খেমটা দিত। আর বুলথ ,এর বাড়ীর বউ,ঝি হয়েই মান সম্মান নাই তো তা আবার তোদের মতো কামিন দের...

সব শুনথাম, তু নিষেধ করথিস ; তাও যেথাম। ক্যানে বুল দেখি? শুন ওদের বাড়িতে একটা ব্যাটা আমার ই বয়সী ... উ কত কত বই আউড়াইত, কত মনীষী দের গল্প গাথা পড়থ  ..রবি ঠাকুর,রামকৃষ্ণ,বিবেকানন্দ, শরৎ চন্দ্র,বঙ্কিমচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ..অ রি লোভে লোভে যেথাম। কত জ্ঞানের কথা, মেয়েদের দুগ্গতির কথা আরও কত কথা ,নিজের আত্ম সম্মানের কথা। আমার শুনথে খুব ভালো লাগথ। আমার তো আর বই কেনার খ্যামতা নাই। ঘরে কুপির লম্ফ। সে আমার সাঁজ এর পরেই লিভে যেথ।

এরই মাঝে অদের ব্যাটা বড় হচে আর বই ও বদলাছে। আমার ও খুব মজা হছে। ক্যানে বল? পুরানো বই গুলান যখন ফেলিং দিথ আমি কুরিং লিথাম। গাঁয়ের ইস্কুলে বাবুদের বাড়ির ব্যাটার ঠিক নীচের কেলাসেই পড়থাম। ওর লেগে ,বই গুলান তো পাব। আমি পেরথম হূত্যাম লয় বল?
সেই সি বার বড় ইস্কুলে রবি ঠাকুরের চন্ডালিকা হবে, কেহু আর প্রকৃতির পাঠ লিলো নাই। বুঝে নি অরা, প্রকৃতির মাধ্যে কি আগুন আছে। ভালোই হোল , মুই কে পাঠ টো দিলে। ডাগর চোখ, কালো রং অদের কোনো নকল প্রলেপ দিতে হোল না মুখে আমার। লাটক শুরুর আগে পর্যন্থই  অরা আমাকে সাথে লিথই না। সাঁওতাল বটি কি না। কিন্তু সবাই বিশ্বাস যেথ , দামিণি সব সাঁওতাল দের মতন লয়। উ কারও কথা শুনে রই না। মুখ ঝামুটি দেয়।

এই মুখ ঝামুটি একদিন প্রেথ্থম বাবুর বাড়িতেই। লগনি কে বাবুরা বুলছে, তোর বিটি টিকে কামিন এ লাগিং দে। মুখ ঝামুটি দিয়েছিলম। তুমার ব্যাটা তো হনু ! উ কাজে লাগবে পৃথিবীর লয়! আমি সাঁওতাল এর বিটি তাই কামিন হবো.. কে অধিকার দিয়াছে তুমাদের ,আমাদের জীবন লিয়ে ছিনিমিনি খেলার।
সব মুনে গাঁথা আছে গো বাবু; যে দিন আমার বাপ টা মদ গিলে গিলে অকালে মলো...আমার মা টো ডাগর ছিল .. আমি ছোট ছিলাম.. তুমরাই গাঁয়ের মাথারা নিদান দিলে ,শিংমুড়া আমার বাপ তো বটে! বাপ টো কে কেউ কাঁধ দিলে না গো। আমরা এক ঘর সাঁওতাল। ভাই নাই, আমি বাপের বিটি, আমাকেও দিতে দিলে না কাঁধ। বুলছে বিটির অধিকার নাই কাঁধ দিবার। মা,বিটি আছুড়ে আছুড়ে কেঁদে গেলাম। কেহু শুনে না গো। বাপ তোকে একটা তালপাতার ডোঙা কোরে দড়ি বেঁধে ছেঁছুড়ে লিয়ে বিলের ধারে ফেলিং দিলে। পুড়ালে ও না। বুলছে পুড়া ধুম্যা গাঁয়ের অশুদ্ধি ঘটাবেক।

সি দিন হোতে আমার জেদ হোলো ,জানিস লগনি মা। আমিও দেখিঙ দিব বাবুদের তোর ব্যাটা টো যদি ব্যাটা তবে লগনির বিটি টিও বিটি...
কিন্তু বিশ্বাস যা, বাবুদের ব্যাটা টো খারাপ লয়।
ও গোপনে আমাকে বই দিয়াছে। গাঁয়ে উচ্চ মাধ্যমিক এর পরে ইংরেজি নিয়ে পড়ল্যাম । তখন পেরাইভেট দিথাম। যা পয়সা পেথাম অতেই হোত। তু তো সবই করেছিস। এর লেগে। এখুন আর কাজ করবি নাই বুঝলি।

শুন ,
মা,তু তো এখন গাঁয়ে। ক মাস পরই তুকে আমার লতুন বাসায় আনব। কত আলা, গাঁয়ের  কলাগাছের থোরের  মতুন ,  কলঘর টো দেখবি আর লাচবি। আমাদের ঘরের থেকেও বড় এই কলঘর। গরম জল ,ঠান্ডা জল এক খান কল থেকেই নামে ।  গরমে আর তোর কষ্ট হবেক নাই । ঘর টই তো পুরো টাই ঠান্ডা।

তু আর আমি থাকব। বাপ টোর একটা ফটক ও নাই। জানিস বাপের একটো ফটোক আঁকায় ছি। দেখিস তো ঠিক হৈছে কি না।

মজার খপর টো লে এবাটি। আমার আপিসে বাবুর ব্যাটা টা কাজ করে। অর এখন ম্যানেজার আমি । যোগ্যতা তেই পেঁয়াছি। অকে আমি খুব পছন্দ কর্থ্যম। অন্য লেগে লয়। এত বড় হোতে উই তো আমায় সাহায্য করেছে.. আর আমাদের ওই মনীষী গণ...
ভালো থাকিস মা.. সামনের মাসেই তোকে লিয়ে আসব। বাড়িতে তোর সাথে এই ভাষা তেই বুলব..চিন্তা করিস না.. আপিসে তো ইংরেজী বলতে হয়...
তোর দামিণি...