Wednesday 22 April 2020

#বেনারসী #মৌসুমী রায় নিভৃতবাস চলছে দেশে । ঘরে বসেই অফিসের কাজ কম্ম । তার উপর আজ রোববার ,আলসেমিতে টানছে বিছানাটা। কিন্তু আজ একটা বিশেষ কাজ করতে হবে। কিছুতেই অলস হলে হবে না। নিজেই নিজেকে বলছে আনন্দী। আজকে আলমারী টা গোছাতেই হবে।অনেকদিন ওইদিকে হাত দেওয়া হয়নি। ঘরের আর অফিসের কাজ সেরে অবসর ই পায় না আনন্দী। গতকাল মাছটা করা আছে ফ্রিজে; আজ একটু সেদ্ধ আর ভাত বসালেই হবে।আলমারী খুলল , আর সাথে একটা কফি খাওয়া কাপে ভর্তি করে দুধচা আর গোটা চারেক তোষরুটি মানে, ওই টোস্ট বিস্কুট।গোছাতে গোছাতে হাত পড়ল একটা শাড়িতে, সিল্ক সিল্ক মতো মনে হোল। শাড়ির গুদাম থেকে এক হ্যাঁচকা তেই বেরিয়ে এল সে। ন্যাপথলিনের গন্ধে ভুরভুর করছে। পেস্তা রঙের শাড়ি আর মেরুণ রঙের কাজকরা। মাঝে মাঝে সোনালী রঙের কারুকাজ। পঞ্চান্ন বছর বয়স শাড়ীটার। রং কিন্তু অটুট তবে খুলে দেখা গেল ভাঁজে ভাঁজে পিঁজে গিয়েছে সে। খুব আলতো করে শাড়ীটা তে হাত বোলাচ্ছে আনন্দী। কত স্মৃতি এতে মেশানো।বাঁ হাতে চায়ে একবার চুমুক দেয় আর পুরোনো কথা গুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মাঝে মাঝে তোষরুটিতেও কামড় বসায়। যতদূর মনে আছে .. আনন্দী তখন সাত আট হবে । বিদ্যালয়ে শিক্ষক দিবসে ও নাচবে। মা,ওঁকে সুন্দর ভাবে সামনে আঁচল দিয়ে শাড়ি পরিয়েছিল,ফুলের সাজে সাজিয়ে ছিল। "সজনী সজনী রাধিকালো" গানের সাথে নেচেছিল ও। দিদিমণি রা ওঁর গাল টিপে আদর করেছিলেন এবং শাড়ীটার তারিফ করেছিলেন। মা কে এসে শাড়ীর তারিফের কথা বলতেই, মা শাড়ির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছিল। শাড়ীতে যে ,সোনালী কাজ গুলো আছে ওগুলো সোনার। আগেকার বিয়ের বেনারসী তে সোনার একটু আধটু ছোঁয়া থাকত। সংসার যেন সোনা র মত উজ্জ্বল হয়ে থাকে চিরকাল । সোনায় কোনোদিন মরচে ধরে না। দিদা ,মা কে একথা বলেছিলেন।মা,তখন কোনো বিয়ে বাড়ি গেলেই এই শাড়ীটা পড়ত। এই শাড়ীর উপর অনেক অত্যাচার হয়েছে। আনন্দী আর মা,শুধুই নয় ; বাড়ির পিসি ,মাসীরাও ব্যবহার করেছেন। কারণ শাড়ীতে সোনার ছোঁয়া। সচরাচর অন্য বেনারসী তে সেটা চোখে পড়ত না। এছাড়াও লোকের খুব প্রশংসা পেয়েছিল শাড়ীটা। রংয়ের জন্যও খুব পসার ছিল ওর। সাধারণত লাল বা মেরুণ শাড়ীর আধিক্য ছিল ওই সময়। আর সেই সময় এই কন্ট্রাস্ট ব্যাপারটা একটু অপ্রচলিত।তাই এর কদর খুব ছিল। মা খুব খুশি হয়ে যেত। শাড়ী টা ধোয়া হতো কম ।উল্টে পাল্টে ভাদ্র মাসের করা রোদে প্রায় ভাজা ভাজা করে নিয়ে,তাঁকে ভাঁজ করে বিছানার তলায় রেখেদিত মা। আর আনন্দী এবং বাড়ির পুঁচকেদের বলত বিছানার, বিশেষ করে ওই জায়গাটায় বসতে। দু,চারদিন পরে, মা শাড়ীটা বিছানার তলা থেকে বেরকরে একটা ফুলকাটা ট্রাংক এ রেখে দিত। মায়ের ওটা বিয়ের ট্রাংক। তালা নেই তাতে ।মায়ের গায়ের রং ছিল দুধে আলতা যাকে বলে। এই শাড়ী টা গায়ে চাপালেই মা কে যেন দুর্গা ঠাকুরের মত লাগত। শাড়ীটার যখন পঁচিশ বছর হবে তখন আরও কাকিমারা বাড়িতে এসেছে। তাঁদের নূতন নূতন বেনারসী। ওই দিকে সকলের ঝোঁক বাড়তে থাকল। এঁর কদর কমতে থাকল। কিন্তু ভাদ্র মাসটি এলেই মা শাড়ীটার যত্ন আত্তি করত। তখন আর বিছানার তলায় দিত না। পিঁজে গিয়েছে তো। হাতদিয়ে টেনে টেনে ইস্ত্রি মতন করত এবং ওই ট্রাঙ্কে ভরত।পঁচিশ ত্রিশ বছর বয়সের ভারে ন্যুব্জ শাড়ীটা তে সোনা আছে এ বাড়ি ও বাড়ি একথা ও কথা তে চাউর ছিল। ওমা একদিন হঠাৎ এক হিন্দুস্থানী বাসনওয়ালী বলে ,ভাবিজী তোমার ওই সোনাওয়ালা শাড়ীটা দিলে তোমায় অনেক বাসন দেব। তৎক্ষণাৎ মা তাকে বিদায় বার্তা দিয়েছিল। আসলে মায়ের খুব ভালোবাসার ছিল ও। বাবাও মা কে তারিফ করত এই শাড়ীটা পড়লে। এছাড়াও মায়ের বাবার দেওয়া শাড়ী। দাদুও এখন ইহলোক ত্যাগ করেছেন। কত স্মৃতি মায়ের এই শাড়ীতে। অর্থের অভাবেও শাড়ীটার হাত বদল করেনি আনন্দীর মা। উত্থান পতনের মাঝেও সে একই যত্ন আত্তি পেত।আনন্দী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানেও পড়েছে শাড়ীটা।শাড়ীটাতে মায়ের আদরের ছোঁয়া লেগে আছে। ভাবতে ভাবতে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা টা প্রায় গিলেই নিল আনন্দী সাথে তোষরুটি টাও মসমস করে দাঁতে পিষে নিয়ে খেয়ে ফেলল।খানিকক্ষণ মায়ের শাড়ীটা তে ঘ্রাণ নিল। পেল সেই বেলাকার এক সুন্দর অনুভূতি। শুধুমাত্র সোনা আছে বলে নয় , এই শাড়ী কত কত ঘটনার ইতিহাস নিয়ে আজও বেনারসী হয়েই আছে।যে বছর আনন্দীর বিয়ে হলো,তখন অষ্টমঙ্গলাতে নূতন শাড়ীর সাথে এই স্মৃতি জড়িত শাড়ীটাও দিয়েছিল মা।তাও নয় নয় করে এই বাড়ীতে প্রায় সাতাশ বছরের বাস শাড়ীটার। এখন আনন্দী শাড়ী কম পড়ে। তাই স্টীলের আলমারীর দিকে কমই যাওয়া হয়। এখন তো ফ্ল্যাটে, সব হাল ফ্যাশনের কাঠের আলমারী। সৌন্দর্য আছে কিন্তু পোক্ত নয়। যাবতীয় জামাকাপড় সব ঝোলানো থাকে হ্যাংআরে। হঠাৎ মায়ের শাড়ীটা পেয়ে কত কথায় না মনে এসে গেল। মায়ের এখন বয়স হয়েছে। প্রতিদিনই মায়ের খবর ফোনে নেয় আনন্দী।এই বার মাকে ফোন করতে হবে। চটপট গুছিয়ে নিতে হবে আলমারী টা। ভাত টাও বসাতে হবে। ন্যাপথলিনের প্যাকেট থেকে নূতন করে ন্যাপথলিন বের করল । শাড়ীটা নূতন করে ভাঁজ করল ,শাড়ীটার ফাঁকে ফাঁকে যত্ন করে রাখল। আনন্দী ভাবছে এই শাড়ীটা তাঁর একমাত্র ছেলের যখন বিয়ে হবে তখন বউমার হাতে গচ্ছিত রাখবে। আলমারী বন্ধ করে ,চাবি দিয়ে বিছানার তলায় রাখল আনন্দী। মোবাইল টা তে মায়ের নম্বরে কল করল। রিং হওয়া মাত্র ওপর থেকে মায়ের গলা , আনন্দী ?...

No comments:

Post a Comment