Saturday 2 September 2017

শুচি 
শৈশব থেকে দুই বোনের প্রাণায়াম নিত্য দিনের। অভ্যেসে কবে যে পরিণত হয়েছে কে জানে। ওমকার উচ্চারণে ঈশ্বরের শক্তি ব্রহ্মাণ্ডময় তরঙ্গায়িত। অজানা শক্তি ,বায়ু তরঙ্গে ভাসমান। সে শক্তি আত্মস্থ করে ওম শব্দে। আনন্দ ভালোবাসার ধন এ ধনী শুচির রাগাশ্রয়ী শ্রেষ্ঠ এবং রবীন্দ্রসংগীত শুভকর। ওর চিন্তায় রবি ঠাকুরের গান সংস্কৃত উচ্চারণে শুদ্ধসংগীতে ধরা দেয়। "ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসায় "..ধরাদিয়ে যায় মেঘমলহার -মিঞাকি মলহার এর তানে। চোখ বন্ধ করে তানপুরায় নাড়া বেঁধে বন্ধনহীন গ্রন্থি তে লঘু -উচ্চাঙ্গ সংগীত বেঁধে রাখে। যেন পদ্ম পাতায় ঢাকা কুন্দ ফুলের জলঝরানো মালা। জলের খানিকটা পদ্মপাতায় টলটল করছে। একেবারে টাটকা। 

সন্ধেবেলা রেওয়াজ করে প্রতিদিন। এক জ্যোৎস্না ভরা রাতের আকাশে জ্যোৎস্না রশ্মির মৃদুল দোলায় দ্রুত -মধ্য লয় গলার দানাদানা কাজ গুলো টের পাচ্ছে। সে এক ইন্দ্রিয়াতীত অনুভূতি। কখনো বৃষ্টি মুখর দিনে আলসে ভরা দুপুর বেলা বৃষ্টিস্নাত গাছের দিকে চেয়ে চলেছে গানের লহরী। এছাড়াও নানান কাজকম্ম ,উনিভার্সিটি নিয়ে ব্যস্ত। 
প্রতিদিনের অভ্যেস নিজের রোজনামচা লেখা। লেখার শেষে আজ হঠাৎ পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে দেখে কতকিছু পাওয়া না পাওয়ার স্মৃতি। পাওনা ,আফশোস ,অনুশোচনা আরও অনেক। চাঁদের আলো বিছানায় ,অপেক্ষাকৃত কম আলোয় স্মৃতি খুঁজে চলেছে। মাঝে মাঝে দিনলিপির খাতাটা বুকে চেপে ধরছে ,ঘ্রাণ নিচ্ছে। সেই ছোট বেলার গন্ধ ,মায়ের হাতের। মায়ের কাপড়ের ভালোলাগার গন্ধ। বিশেষকরে মা রান্না করতে করতে কাপড়ে হাতমুছতে মুছতে বলত শুচি -রশ্মি হোম ওয়ার্ক গুলো হল তোদের। মনে পড়ে দুষ্টুমি করলে মা বলতো দাঁড়া তোদের বাবা আসুক সব বলে দেব। বাবা কে ভয় পেতোনা মা সেটা জেনেও বলতো। বাবা ওদের বন্ধু। চুপিচুপি বাবার সাথে খেলা ,বায়না কত কিছুই না করত। 
মনে এল স্কুলের মাস্টার মশাই দিদি দের কথা। সবাই স্নেহ করতেন। এমনকি দাড়োয়ানের কথা। টিফিন শেষ হলেই বলতো ক্লাসে যাও। মনে পড়ে স্কুলের গেটের ওপারে ফুচকাকাকু কে। বলতো ওকাকু একটু তেঁতুল মাখা দাও তাড়াতাড়ি টিফিনের শেষ ঘন্টা পড়ে যাবে। বসন্তে শান্তিনিকেতন যাওয়ার কথা। গৌড় প্রাঙ্গনেবসন্তউৎসব ,গাছে পলাশের মেলা ,পারুলের উঁকিঝুঁকি। যা ছিল কালো ধলো গানের শেষে শালপাতার দোনায় রাখা আবীর ছড়িয়ে দেওয়া। তখন এ ওর কপালে ,গালে একটু আবির ছুঁয়ে দেওয়া। আবার বিকেলে বৈতালিক। কত স্মৃতি আজ ভিড় করেছে। বোলপুর যেতে আসতে আউলবাউল এর গানশোনা আবার সুরেসুরে গলা মেলানো। 
মা বলতো বেগম আখতারের জোছনা করেছে আড়ি গানটা গাইতে। বারবার গাইতে বলতো গাইতে গলি দিয়ে চলে যায় লুকিয়ে রূপোলি শাড়ী। পড়তেপড়তে শুচির বুকফেটে চোখবেয়ে জলের ধারা নেমে এলো। 
প্রকৃতির নিয়মে আকাশের কালো মেঘ দেখে অভ্যস্থ। কিন্তু জীবনে এই মেঘের গায়ে দ্বিতীয় মেঘ দেখেছিলো। এতো কালো মেঘ কোনোদিনও দেখেনি। ডক্টরেট পাওয়ার পরেপরে মায়ের দূরারোগ্য খবর। তখন আর কিছুই করার ছিল না। মায়ের চলে যাওয়ার দিন বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে পারেনি। সেই দিন ও অভিভাবিকা। আজ পাতা ওল্টাতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছে। যত পারিস কেঁদে নে। কেও দেখবে না ,কেও নিষেধ করবে না। বুকের ওপর খাতাটা রেখে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে শুচি ।মৌসুমী @ 

No comments:

Post a Comment