Thursday 7 September 2017

শুচি 
শেষ পর্ব 
ভিন্নতালের বাচ্চারা এখন একটি তালে সুর বেঁধেছে। শুচির আনন্দ আর ধরে না। ঘরে নতুন সদস্য আসছে। সুতরাং হাতে কলমে কর্ণ চক্ষুর বিবাদ ভঞ্জন ঘটাতে হবে। গর্ভস্ত সন্তান এই পরিবেশে একটু একটু বাড়তে থাকলে তার প্রভাব কী পড়ে ? পরীক্ষা প্রার্থনীয়। 
ওই বাচ্চাদের নিয়ে প্রথম শুরু করে দম বাড়ানোর  জন্য ,ওষ্ঠ ,দন্ত ,তালুর এবং জিভের সঞ্চালনে শব্দ সৃষ্টি অনুশীলন। কথা বলতে গেলে থেমে থেমে ,কেটে কেটে এবং বুকভরে শ্বাস নিয়ে শব্দ পরিবেশন। এতে মাধুর্য বাড়ে আবার কণ্ঠ সুরে ভরে ওঠে। কিছু ছেলেমেয়ে বাচন ভঙ্গিতে পারদর্শী। শুচি গীতবিতান পরে শোনায় ,ওরা আবার সেগুলো ছন্দে দমের ব্যবহারে সাজিয়ে তোলে। কণ্ঠস্বরের ওঠানামা যে বাচ্চারা অত স্বচ্ছন্দ নয় তারাও তালেতালে তালি দেয়। সুরে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে। যা ওদের নিস্পৃহ চোখ দুটোতে ফুটে ওঠে। ওদের মা বাবা এখন এই থেরাপি তে উৎসাহিত। ওদের প্রতিক্রিয়া ভালোলাগা ,মন্দলাগা উভয় আছে। এতদিন যারা বাতিলের খাতায় রেখেছিলো এদের তারা জানবে এই ছেলেমেয়েদের ও ভালো ,মন্দ দুইয়ের অনুভূতি আছে। 
কিছু বাচ্চাদের গানের প্রতি ভালোলাগা আছে। গানের প্রতি বিশেষ নজর দেবার প্রস্তুতি চলছে। তাদের বোঝানো হয় গানের উপজীব্য ভক্তি ,শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস। কণ্ঠস্বর ,সুরবোধ ,স্বরলিপি ,উচ্চারণ ,নিঃশ্বাস -প্রশ্বাস ,শুনে শুনে রপ্ত করা। তালের পরিমিতি বোধ এবং সংযম ভীষণ জরুরী। জীবনে চলার পথে সংযম এবং তালের যেমন প্রয়োজন তেমনি সংগীতে। 
এভাবে চলতে চলতে সাত মাস অতিক্রান্ত। শুচি আজকাল অনুভব করে যখন গান -কবিতা পরিবেশন করে তখন গর্ভস্থ শিশুটির সঞ্চালন তালে তালে এবং সুরেসুরে। গলার ওঠানামা শিশুর চঞ্চলতা টের পাওয়া যায়। শুচির গর্ভে দুটি শিশু ছন্দে ,সুরে বড় হচ্ছে। 
শুচি দেখে , যে বাচ্চারা মানসিক দিকদিয়ে পিছিয়ে তারা গোড়াতে খুব চঞ্চল এবং অবাধ্য গোছের। এমনকি কিছু স্বাভাবিক বাচ্চারাও খুব অস্থির প্রকৃতির। তাদের বড় হওয়ার পরিবেশ ছিল অস্থিরতায় ভরা। এই একবছরে ওদের পরিবর্তন মন কে তৃপ্তি দেয়। শুনে শুনে বিশেষ ছেলেমেয়েরা কিছু করার চেষ্টা করছে। ওরা নিজেদের মত শব্দকরে ,আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে।অন্যান্য সহকর্মীদের হাতে মাস খানেকের দায়িত্ব দিয়ে নতুন সাথীদের সঙ্গে সময় কাটাতে চায় শুচি। সেই উপলক্ষে বাচ্চারা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অপটু হাতের ঘর  সাজানো , কিছু গান ,কবিতা  পরিবেশন করে ওরা। 
শুচি সেদিন গান গেয়েছিল " তোমায় নতুন করে পাবো বোলে হারায় ক্ষণে ক্ষণ ও মোর ভালোবাসার ধন ,তুমি আমার নও আড়ালের তুমি আমার চির কালের "---
 শ্রীনি সবাই কে  মিষ্টি মুখ করালো। শুচি একটি মেয়ে এবং একটি ছেলের জন্ম দিয়েছে। ওরা সবাই সুস্থ আছে। 
শুভ সংবাদে আকাশ বাতাস চঞ্চল। মাস দুয়েকের আগেই শুচি এই বাচ্চাদের সাথে ওর দুই বাচ্চাদের নিয়ে তালিম দিতে শুরু করল। দিনে দিনে যেমন বাড়ে শশী কলা তেমন ই এদের সকলের মনোন্নতি ঘটতে লাগলো। ওদের সাথে সুরে ,ছন্দে এরাও সুরেসুরে কলকল করতে থাকে। .আশাবরী আর অভিপ্ৰীত বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। ওরাও গান ,কবিতায় আচ্ছন্ন। বাড়িটা সুরেলা ছন্দময় এবং সাংস্কৃতিক ভাবাপন্ন। শুচির বাবা একজন আদর্শ শিক্ষক কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। বাবা মেয়েদের স্বপ্নের নায়ক। সব মেয়েরা চায় বাবার মত হতে। জীবন সাথীও যেন বাবার মতো নীতি বোধের অধিকারী হয়। শুচির অর্ধেক আকাশ অনেকখানি সেই রকম। ওদের বাচ্চারা স্বাভাবিক ভাবে বড়ো হচ্ছে। গান ,কবিতা আর ওর বিদ্যালয়ের বাচ্চাদের সাথী করে এগিয়ে চলছে। মুক্ত মনে মুক্তির খোঁজে। 
শুচি ওঁর গবেষণার ফল হাতে নাতে পেয়ে চলেছে। জন্মের সময় থেকে উপযুক্ত পরিবেশে ভ্রূণের বৃদ্ধি ঘটলে অনেকাংশে সুফল পাওয়া যায়। সুতরাং মানুষ টাটকা ফলপেতে আসক্ত। এই নেশা আজ শুচির বিদ্যালয়ে ভিড় জমিয়েছে। 

আজ শুচির বাবার চলে যাওয়ার বর্ষপূর্তি। বাবাও দূরারোগ্য ব্যাধির শিকার। মন ভার। কিন্তু ওঁর বিদ্যালয়ের বাচ্চারা এবং আশাবরী ,অভিপ্ৰীত রা সংগীত ,কাব্য ,ছন্দের সন্ধ্যা র  আয়োজন করেছে। উত্তরণের পথে পথে জুঁই ফুলের মালা , দীপ  ,ধূপের গন্ধে ভরেছে মন মন্দির। এই মন্দির মানব মানবীর মন্দির। এখানে মানুষ পূজারী। অসুস্থ মনের ঠাঁই নেই। সুস্থ  মানুষের তরী তে ঠাঁই হবে শুধু সুষ্ঠু ভাবে কাজ এর কাজী বলো ,পোপ বোলো আর ঋত্বিক বোলো সেই পথ দেখানোর নাবিকের।মৌসুমী @. 

No comments:

Post a Comment