Tuesday 19 February 2019

মঞ্জরী

মঞ্জরী

#মৌসুমী রায়
ও মঞ্জরী আমের মঞ্জরী ...

গাইতে গাইতে প্রায়ই ,মেয়েটি হেঁটে যায় এই গ্রামে।
শ্যামলা বরণ,দিঘল চোখ দুটির পানপাতা মুখে মিষ্টি লাগে ওঁকে।

প্রকৃতি ,প্রায় ই লণ্ঠন নিয়ে দিনের বেলায় , কি যেন খুঁজে ফেরে। অনেকে ভাবেন এ যেন ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশ পাথর।
সে যায় হোক ,তেমন বিশেষ আমল দেয় না কোনো কথায়! সে ,শুধু হাসে। হাসিতেও লোকজনের নাকি  পাগলী  মনে হয় ওকে। এই গ্রামে হঠাৎই প্রকৃতির আবির্ভাব।
একটা হিল্লে করতে হবে এই মেয়ের। ভাবনা শুরু।

অনাথ ভাবেই ওর জীবন যাপন।  গ্রামের মুরুব্বি রা ওর নাম করণ করেছে।  কারণ ও ,ম্লেচ্ছ  না হিন্দু সেকথা জানা নেই।  অতএব মেয়ে যখন,তখন ওর নাম হোক প্রকৃতি।  এখন ওর ,লণ্ঠন নিয়ে খুঁজে  ফেরা টাকে বিশেষ কিছু মনে হয় প্রতিবেশী দের।
এত দিন কেউ না কেউ ওকে, খাবার দাবার এবং বাসস্থান দিয়ে এসেছে। ভাবনা এখন বাস্তবের পথে।
এখন ওঁর জন্য একটা ঘর,কলঘর এবং গোসল ঘর করে দেওয়া হয়েছে সরকার এর সাহায্যে।
ওঁর আনন্দ বোঝা যায় না। তবে খুশিতে,  ও মঞ্জরী গান টি গায়। ওঁর চোখের উতল চাহনি তে প্রকাশ পায়। পূর্বের কথা জানতে চাইলেই ,দিনের বেলায় লণ্ঠন হাতে খোঁজ শুরু করে।

ইদানিং লক্ষ্য করছে গ্রামবাসীরা ,প্রকৃতি গ্রামের অবহেলিত ছেলে এবং মেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছে।  তাদের অল্প বিস্তর গান গাইতে এবং আঁকতে শেখাচ্ছে। আবার মাঝে মধ্যে নিজে কবিতা আবৃত্তি করছে।  হাতের মুদ্রায় নৃত্যে র চলন বোঝাচ্ছে।
কিন্তু, কোন সুস্থ বাড়ির বাচ্চাদের এ ব্যাপারে সাহায্য করে না ওঁ।  তাদের বলে ,তোমাদের তো অনেকে আছেন যাঁরা তোমাদের এগোতে সাহায্য করবেন।  এঁদের কেউ নেই যে ! দেখার।
আস্তে আস্তে  এভাবেই প্রকৃতির একটা ছোট খাটো স্কুল তৈরি হলো বাড়িতে। ওর চেহারাতে বনেদিয়ানা প্রকট। কিন্তু বোঝার অবকাশ দেয় না।

প্রায় দুই বছর অতিক্রান্ত । প্রকৃতি ঠিক করল এই বসন্তে ,এই ছেলে মেয়েদের নিয়ে একটা নাটক মঞ্চস্থ করবে।  ওঁর কথা এখন গুরুত্ব দিয়ে শোনেন গ্রামের মানুষেরা ।
কথা বলেন গ্রামের মুরুব্বি দের সাথে। মুরুব্বিরা এখন প্রকৃতি কে ,আর সে ভাবে দেখেন না।  তাঁর কথার যথেষ্ট মান্যতা দেন।  অনুষ্ঠানের জন্য নিয়মিত অভ্যেস চলছে। বিকেল টা বেশ কাটছে!

তাঁরা সকলে চাঁদা তুলে মঞ্চ বাঁধলেন,পোশাক পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করলেন। মঞ্চস্থ হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা চন্ডালিকা।  নাটক টাকে একটু নিজের মত করে মঞ্চস্থ করার চেষ্টা প্রকৃতির।  কারণ ,রবি ঠাকুর কে হুবহু উপস্থাপনা করা তাঁর কম্ম নয়।
প্রথমেই নিজের কণ্ঠে সুর ধরলেন ,আমি তোমার মাটির কন্যা জননী বসুন্ধরা... এরপরে অচ্ছুৎ কন্যার হাতে জল গ্রহণ ..  জল দাও ! এযেন কতদূর এর এক তৃষ্ণার্ত  পথিকের ডাক।
গা ,শিউরে ওঠে।। 
একের পর এক চমক চলতে থাকে। শেষে পরিবেশন, মাটির বুকের মাঝে বন্দি যে জল...মাটি পায় না,.
হাত তালিতে আকাশ বাতাস মুখরিত।  বলা বাহুল্য অনুষ্ঠানটি দিনের বেলায় হয়েছিল। গ্রামে তখন বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল না। হ্যাজাক এর খরচ করতে সামর্থ্য ও ছিল না।  তার উপর এক অপ্রকৃতিস্থ নাটক পরিবেশন করবে। কি না কি সাপ, ব্যাঙ বেরুবে।   দর্শক দের মুখে মুখে ,আমি তোমার মাটির কন্যা.,.

যাই হোক ,সেই দিন অনুষ্ঠানে র শেষে,  এক ব্যক্তি র হঠাৎ আবির্ভাব। সে খুঁজতে খুঁজতে , এই গ্রামে উপস্থিত। প্রকৃতি , তাঁকে চিনতে পেরেছিল। কিন্তু অপরিচিত , এই ভান করে ছিল।

অনুষ্ঠান শেষে , মঞ্চের পিছনে গিয়ে নতজানু হয়ে, সে,  প্রকৃতি কে বলে,আমি তোমার জন্য কিছু করতে চাই, বলো তুমি কী চাও?

প্রকৃতি ,খানিক টা আবেগ মথিত হয়েও উত্তর দিয়েছিল,  সরে দাঁড়াও তো একটু;  
সূর্যের আলো টাকে আসতে দাও।  এই আলো, তোমার কেনা গোলাম নয়।  নই আমিও।

যেদিন  ,দুই মেয়ে জন্মদেওয়ার পরে , তাঁদের মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছিলে ,সেদিন কিছু জানতে চাও নি,আমার কী প্রয়োজন!
ওঁরা আজ জীবিত থাকলে, এঁদের মতোই হোতো।

কিছু চায় না,কিছু করতেও হবে না।
আমার স্বাস প্রশ্বাস টা এই সূর্যের আলোতে নিতে চায়।
এখন থেকে এরাই আমার সব।  বঞ্চিত করে, তুমি বাঁচালে মোরে।  তফাৎ যাও,সূর্যের আলোটাকে আসতে দাও।  লণ্ঠন  নিয়ে, ঠগীদের খুঁজেছি অনেক।  এখন ,লণ্ঠন আর দরকার নেই, এখন সূর্যের আলোর হদিস পেয়েছি।।।।।

No comments:

Post a Comment