Friday 26 May 2017

বড়মা 
পর্ব -চার
নব বধু  আদর যত্নে আছে। দুই শাশুড়িমার শাসনেও। নিজের মত থাকে --বকুল ফুল তুলে এনে মালা গাঁথে। পূজার আসনে দেয়। বকুল ফুলের প্রেমে বকুল বিছানো গানটি গুনগুন করে। শাশুড়িমার কথা এবং উচ্চারণ তাঁর কেমন যেন  ঠেকে। মিষ্টি অথচ তাঁর মত নয়। " কে এয়েচে -নুচি -নেবু -নংকা -নোয়া -বৌমা এঁটো রয়েছে নাফিয়ে চল দেখি তো মা। "বেশ মজা লাগে তাঁর। মাঝে মাঝে মা, ছেলে কে লুকিয়ে নারকেল নাড়ু খেতে দিচ্ছে। এভাবেই দিনকাটতে কাটতে বাড়িতে নতুন সদস্যের আগমন। নতুন গোপাল আদরের ধন। মা -বাবা -ঠাকুমা -পিসিঠাকুমা সকলের ভালোবাসায় বাচ্চাটি বিছানায় শোয়ার ফুরসৎ পায়না।গোপালের গায়ের রং শ্যামউজ্জ্বল। সে নিয়ে প্রতিবেশীদের কথা উঠলে পিসিঠাকুমা বলতেন "রাং লয় -পিতল লয় -গোপাল আমাদের শুধুই সোনা ".--- কালো গাই এর দুধ গোপাল কে খাওয়ানো হত। কয়েক বছর পর তাঁর ভাইও এল। পরিবার বড় হতে লাগল।ভাইটির গায়ের রং ধবধবে সাদা। প্রতিবেশী রা ডাকে কালো সোনা আর ধলো সোনা। আরও চার ভাইবোন সংসারের সদস্য। জমজমাট কবরেজবাড়ি। 
ইতিমধ্যে পিসিঠাকুমার বার্দ্ধক্যজনিত কারণে দেহাবসান ঘটে।

 ঠাকুমা বড় নাতবৌ দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বড় নাতি আর কবরেজ হন নি। সরকারি চাকুরীজীবি ছেলে। হবু  নাতবৌ খোঁজা শুরু। সেই সময় ডাকযোগে চিঠি আসত -সে কবে এসে পৌঁছাবে তার দিন ক্ষণ  গুনে বলা যেত না। সে তাঁর মত আসবে। কিন্তু এদিকে যে সবুর সইছেনা। ছেলের বাবা -ছেলের মা কে ভালোবাসা মাখানো স্বরে বলেন "গোপালের মা আজও তো খবর হল না ".--অন্য সময় স্ত্রীর সাথে কথা হয়না। নানা লোকে নানা কথা বলবে। যে যুগে যে চল। 
বড়ছেলের বিয়ে হল ধুমধাম করে। বড় নাতবৌটি তাঁর মনের মতন। যেমনটি চেয়েছিলেন তেমনটি। চোখের আড়াল করতে চাইতেন না। নব বধুটিও ছোটছোট দেবর -ননদের মাঝে খুশিতেই থাকত।বড় নাতির ঘরে ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তানের আগমন হল।  নাতিনাতনি দের ঠাকুমা বললেন "মেয়ে হয়েছে বলে নাতবৌ কে কেউ নুকিয়ে চুরিয়ে  কিচ্ছুটি বোলো না ---ও মেয়ে আমাদের ঘরের নক্ষী। "---বাড়িতে ছোট্ট মেয়েটি সকলের প্রিয়। মেয়েটি গ্রামের বাড়িতে গরমে কান্না কাটি করলে বড়মা বলতেন  "আহা ,নাইট -পাখায় জম্ম ; ওর কষ্ট নাগচে ,পাখা কর ।" আরও নাতি পুতির আনাগোনা চলতে লাগল। মেজো নাতি -বড় নাতনির বিয়ে হল ধুমধাম করে। ঠাকুমার তখন বয়স হয়েছে আস্তে আস্তে ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটছে। সেই কাজে তাঁর ভীষণ সহযোগিতা। তিনি বলতেন "নেকা পড়া করিনি কোনদিন "---
কিন্তু তাঁর জ্ঞান এর ভান্ডার" তারিফ এ কাবিল" । সময়ের কাছে তিনি ভীষণ দায়বদ্ধ। হ্যাঁ কি যেন বলছিলাম --মেজ নাতির বিয়েতে তাঁর বড় নাতি  বলে ,তাঁর পাত্র ভাই কে,   বরযাত্রীদের রওনা হতে দেরী -দেরী বরেরও --পাত্রীর বাড়ি পৌঁছতে হবে।তখন তো আর চলভাষের চলন ছিলনা।  বড় নাতির কথার এবং সময়ের খেলাপ না পসন্দ ।  ওনারা চিন্তা করবেন তাই "আমি পাত্রীর বাড়ি চললাম --বরকেও যেতে হবেনা বরযাত্রীকেও না "----..ঠাকুমা বড় নাতি কে বলে ; বিয়েটা মেজো নাতির ; তাঁর নয়।  হাসি -মজা -ঠাট্টা --....সকলে এভাবেই আনন্দ করত -----ঠাকুমা তাঁর ছেলের নাতিনাতনিদেরও প্রিয় ছিলেন। তাঁর হাতে ভাঁড়ার ঘর এর কুলুপ।  বাচ্চারা বায়না জুড়ত বড়মা নাড়ু -মুড়কি দাও। কত যে নাড়ু -মুড়কি -নিজের হাতে তৈরি করতেন । চিঁড়ে -মুড়ি -সিঁড়ির নাড়ু । বিরক্ত হতেননা কোনও সময়। কষ্ট সহ্যের মাত্রাও সীমাহীন। অতিথি আপ্যায়ন করতেন ।হাতের তৈরি খাবার  দেওয়া হত । গ্রামে কিছুই পাওয়া  যেত না।
বাড়িতে গাই এর দুধ থেকে সুস্বাদু মিষ্টি তাঁর মত করতেন ।সবাই তাঁর হাতের বানানো খাবার সক্লের প্রিয় ।
 কখনো কখনো বাড়ির বলদজোড়ার তান্ডবে শিং এর গুঁতোতে রক্ত ঝরেছে যন্ত্রনা মুখেচোখে কিন্তু তিনি বিকার হীন ----তাঁর মনের যন্ত্রনা থাকলেও কাকপক্ষীতেও টের পায়নি।বয়সের ভারে শরীর ভেঙেছে।
 মোড়ল দের  ভ্রূকুটি অগ্রাহ্য করে ছেলে তাঁর শখ আহ্লাদ পূরণ করেন । কুলুঙ্গিতে তাঁর থাকত ছোট্টএকটি আরশি আর একটি কাঁকই মানে চিরুনী। ছেলে বড় হওয়ার পর মা কে চুল আঁচড়াতে বলেন। নাতবউ এর প্রসাধন নাতবউ ঠাকুমাকে মাখিয়ে দেয় । বক্তব্য ওই বিধি বিধান পালন করতে হবে না। যা সইবে তাই রইবে।-----
  তাঁর ছোটনাতনীর বিয়ের জন্য ব্যস্ততা। তিনি দেখেযেতে চান।সেই সময় সবে গ্রামে বিদ্যুৎ আসতে শুরু করেছে। -----   

No comments:

Post a Comment